সরকারি চাকরি থেকে কোটা প্রায় তুলে দেওয়ার পথে হাঁটছে সরকার। ব্যাপক সমালোচনার মুখে এসংক্রান্ত সচিব কমিটির জন্য নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই সরকার কোটা থেকে সরে আসার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোটা বিষয়ে সরকারের আগের কঠোর অবস্থান পাল্টানোর এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন কোটা সংস্কারসংক্রান্ত সচিব কমিটির একজন সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সচিব কমিটির সভায় কোটা প্রায় তুলে দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, বাতিল ও পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত সরকারি কমিটির প্রাথমিক সুপারিশ হলো কোটা প্রায় পুরোটাই উঠিয়ে দেওয়া। এর পাশাপাশি মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ারও সুপারিশ এসেছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই কমিটির সভাপতি ও মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এ তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘কোটা নিয়ে সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি। আমরা মেরিটকে (মেধা) প্রাধান্য দিয়ে অলমোস্ট (প্রায়) কোটা উঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করব। তবে কোর্টের একটা রায় রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সংরক্ষণ করতে হবে। যদি খালি থাকে তবে খালি রাখতে হবে। এটার ব্যাপারে কোর্টের মতামত চাইব, কোর্ট যদি এটাকেও উঠিয়ে দেয় তবে কোটা থাকবে না। আর কোর্ট যদি রায় দেয় যে ওই অংশটুকু (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) সংরক্ষিত রাখতে হবে, তবে ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি সবটুকু উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এটা হলো প্রাথমিক পজিশন।’
মন্ত্রিপরিষদসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একজন সাংবাদিক বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ থাকলেও কোর্টের পর্যবেক্ষণ তো বাধ্যতামূলক কিছু নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘এটা পরিষ্কার নয়। আমরা কোর্টের রায়টা বিশ্লেষণ করেছিলাম। এটা আমরা নিজেরা পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। এ জন্য কোর্টের মতামত চাওয়া হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কোর্টের ইন্সট্রাকশন বলেন, অবজারভেশন বলেন, এগুলো আমাদের নির্বাহী বিভাগের জন্য বাইন্ডিং হয়ে যায়। এগুলো আমরা ইগনোর করতে পারব না। যেভাবে লেখা আছে তা বাইন্ডিংয়ের মতোই।’
মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত হলো যত দূর সম্ভব কোটা বাদ দিয়ে মেরিটে চলে যাওয়া। এখন আমাদের সময় এসেছে, আমরা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় যাব।’ তাহলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মূলধারায় আসবে কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি, ওনারা অনেক অগ্রসর হয়েছেন।’
কোটা সংস্কারসংক্রান্ত সচিব কমিটির একজন সদস্য গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোটা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব সাংবাদিকদের যা বলেছেন সে সম্পর্কে কমিটির বৈঠকে কিছু আলোচনা হয়নি। মনে হচ্ছে কোনো সমাধানে যেতে চাচ্ছে সরকার।’
সচিব কমিটির ওই সদস্য আরো বলেন, ‘কমিটি ৮ জুলাই প্রথম সভা করার পর আরো কয়েকটি সভা হয়েছে। সেখানে আদালতের রায়ের বিষয়টিও এসেছে। কমিটির বৈঠকে আদালতের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর বাইরে যা হয়েছে তা সমস্যা সমাধানের লক্ষণ মনে হচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত রবিবার কোটা সংকট সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) মিলনায়তনে এক আলোচনাসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘কোটা আন্দোলন যাঁরা করেন, তাঁদের আমি সুখবর দিতে চাই। কিছুদিন ধৈর্য ধরতে অসুবিধা কী? একটি ব্যালেন্স সিস্টেম চালু করার জন্য কিছুটা সময় লাগছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কিছুটা সময় লাগছে। এটি এখন অনেক দূর এগিয়েছে। আমরাও সমাধানের পথ খুঁজছি। ছাত্র-ছাত্রীদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
সেদিন সকালে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ঘোষণা দিয়েছিল, ৩১ আগস্টের মধ্যে কোটাসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে ফের আন্দোলনে নামবে তারা। জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক সমাবেশ থেকে ওই ঘোষণা দেন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত ২ জুলাই কোটাব্যবস্থা পর্যালোচনা করে তা সংস্কার বা বাতিলের বিষয়ে সুপারিশ দিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল সরকার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব, অর্থসচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব। কমিটির কার্যপরিধিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা, সংস্কার ও বাতিলের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করার কথা বলা হয়। কার্যপরিধিতে আরো বলা হয়, বর্তমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার বা বাতিলের প্রয়োজন হলে তার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সুপারিশ করতে হবে কমিটিকে। কমিটি ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। ৮ জুলাই প্রথম সভা করে কমিটি। পরে কমিটির মেয়াদ আরো ৯০ কার্যদিবস বাড়ানো হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে বর্তমানে ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হয় কোটায়। বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধার ভিত্তিতে। বিসিএসসহ প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, জেলা কোটা ১০, নারী কোটা ১০ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতেও আছে বিভিন্ন ধরনের কোটা। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। আন্দোলনকারীরা কোটা ১০ শতাংশে কমিয়ে আনার দাবি তোলে। কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে তা পূরণ করার দাবিও জানাচ্ছে তারা। আন্দোলনের একপর্যায়ে গত মার্চ মাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে পুলিশ। পরে ৮ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে আন্দোলনকারীদের পুলিশ লাঠিপেটা করলে এবং কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই ঘটনার পর আন্দোলন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় গত ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘কোটা নিয়ে যখন এত কিছু, তখন কোটাই থাকবে না। কোনো কোটারই দরকার নেই। যারা প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের আমরা অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব।’
এরপর ৮ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কোটা সংস্কারের জন্য খসড়া কমিটি করে তা অনুমোদনের জন্য পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেই কমিটি অনুমোদন হয়ে সচিবালয়ে ফেরে ৫৫ দিন পর।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন