দাকোপ উপজেলার নলিয়ান গ্রামের সোনাই মল্লিকের স্ত্রী রিজিয়া বেগম (৫৫) বান্দরবান থেকে নিজ এলাকায় ফিরে এসেছেন মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে। জমি-জমা নেই। বসতবাড়ি চলে গেছে নদীগর্ভে। জমি নেই। কিন্তু জন্মসনদ নিতে ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে হয়েছে। পরিশোধ করতে হয়েছে খাজনা। মেয়ের বিয়ে দিবেন তাই জন্মসনদ প্রয়োজন। আইলার তিন বছর পর চলে যান স্বামী সন্তান নিয়ে পাহাড়ি এলাকা বান্দরবান। পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করেছেন। কিন্তু পাহাড়েও ধস লেগেছে। ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন এ আশঙ্কায় ভুগছেন তিনি।
শুধুমাত্র রিজিয়া বেগম এমন শত শত মানুষ গত নয় বছরে আইলাদুর্গত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন। কেউ দেশত্যাগও করেছেন। যদিও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এলাকার বাইরে চলে যাওয়া মানুষের পরিসংখ্যান দিতে চান না।
রিজিয়া বেগম জানান নলিয়ানের কেওড়াতলী গ্রামে নদীর পাড়ে তাদের সুন্দর সাজানো গোছানো ভিটেমাটিতে ২ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে ভালই দিন কাটছিল তাদের। ছিল গরু, ছাগল হাঁস মুরগি সবই। কিন্তু ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলায় ঘরবাড়ি হারাই। এরপর আস্তে আস্তে বসতির জমিটুকুও চলে যায় নদীগর্ভে। কিছুদিন খুলনা শহরে বসবাস শুরু করেন। স্বামী সোনাই মল্লিক দিনমজুরী করে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সংসার চালান, ঘর ভাড়া দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাই ঠিক করলেন বান্দরবন চলে যাবেন সেখানে পাহাড়ের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। স্বামী ও ছেলে ফার্নিচারের কাজ করেন বলে তিনি জানান। মর্জিনারা সুতারখালী ইউনিয়নের ভোটার।
কালাবগী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সালাম ঢালী (৬০) বলেন, কালাবগী বিলে তার ৫০ বিঘার বেশি জমি ছিল। কিন্তু আইলার পর একটু একটু করে সব জমিই এখন নদীগর্ভে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধের উপর এখন বসবাস করছি। তিনি বলেন, সরকার এত অনুদান দিয়েছে কিন্তু আমি কিছুই পাইনি।
নলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা নগেন্দ্র নাথ ঢালী (৬৫) জমিজমা সবই ছিল। ধান যা উৎপাদন হত তা দিয়ে বছর কেটে যেত। কিন্তু আইলার সময়ে বাঁধ ভেঙ্গে বসতবাড়ি নদীতে চলে গেছে। একের পর এক ২৬ বিঘা জমিও চলে গেছে শিবসা নদীতে। এখন নদীতে মাছ ধরার কাজ করেন। কিন্তু তেমন মাছ পান না। কষ্টে জীবন যাচ্ছে।
দাকোপের গুণারী বাজার এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম গাজী (৫৫) জানান এক সময়ে সবই ছিল। আইলার সময় সবই গেছে। সে সময়ে ভাঙ্গণের কবর থেকে উদ্ধারের কেউ ছিল না। বর্তমানে দিনমজুরী করে সংসার চলছে বলে জানান তিনি।
আইলার পর দাকোপের নলিয়ান, গুনারী বাজার, নলিয়ান ফরেস্ট অফিস সবই ভাঙ্গণের কবলে পড়েছে। বিকল্প বাঁধ দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপরও কতদিন টিকবে সেটা বলতে পারলেন না ফরেস্ট অফিসের কর্মকর্তারা।
দাকোপ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শেখ আব্দুল কাদের জানান, আইলা দুর্গতদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর থেকে কোন আলাদা বরাদ্দ নেই। তিনি বলেন আমি দুই বছর দাকোপে পিআইও (প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ দুই বছরের মধ্যে কোন বরাদ্দ আসেনি।
দাকোপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মারুফুল আলম বলেন, আইলা দুর্গতদের জন্য বিশেষ ভাবে কোন বরাদ্দ নেই। তবে সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে ১০০ পরিবারকে আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বর্তমানে জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পের অধিনে ৫২টি পরিবারকে পুনর্বাসনের কাজ চলছে। তিনি বলেন, এলাকা ছেড়ে অন্যত্র কি পরিমাণ লোক চলে গেছে তা বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়ে কাজের জন্য লোকজন বাইরে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলায় দক্ষিণের জেলা খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি এখনও কাটিযে উঠতে পারেনি সেখানকার মানুষ।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন