বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা অনেক কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির নতুন মহাপরিচালক সাফিনুল ইসলাম। জানান, চলতি বছরে সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে কোনো বাংলাদেশির মৃত্যু হয়নি। আর দুই দেশ সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে দুই দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বৃহস্পতিবার বিজিবি সদর দপ্তরে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৪৬তম সীমান্ত সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।
গত ২৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয় এই সম্মেলন। আলোচনা শেষে চুক্তি হলেও সম্মেলনের আনুষ্ঠনিকতা শেষ হবে আগামীকাল শুক্রবার লালমনিরহাট সীমান্তে।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের সম্মেলনেও প্রাধান্য পেয়েছে সীমান্তে হত্যা, চোরাচালান, অস্ত্র পাচার, সীমান্তে অপরাধসহ নানা ইস্যু। আর সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য বছরের মতোই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন হয় সীমান্তে হত্যা নিয়েই।
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে সীমান্ত হত্যা বরাবর একটি প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের বিষয়টি। ৯০ দশক থেকে এখন অবধি এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও আছে।
তবে ২০০৯ সালের পর থেকেই এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ উচ্চকিত হয় এবং বারবার ভারতের বিভিন্ন পর্ায়ে কথা বলেছে ঢাকা। আর এর ফলও মিলেছে। পরিসংখ্যান বলছে যে, ধীরে ধীরে কমে আসছে সীমান্ত হত্যা।
বিজিবির হিসাবে ২০১৭ সালে সীমান্তে নিহত হয়েছেন ২১ জন বাংলাদেশি। আগের বছর এই সংখ্যাটা ছিল ৩১ জন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে হিসাবে ২০১৫ সালে সীমান্তে নিহত হয় ৪৫ জন বাংলাদেশি। ওই বছর অবশ্য তার আগের বছরের তুলনায় সংখ্যাটা বেড়েছিল। আগের বছর এই সংখ্যাটা ছিল ৩৩।
আরেক মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর হিসাবে, ২০১৩ সালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৯ জন। ২০১২ সালে ৩৮ জন আর ২০১১ সালে ৩১ জন। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৪ জন, আর ২০০৯ সালে ৯৬ জন।
অর্থাৎ বর্তমান সরকারের নয় বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ৩৬৭ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। অর্থাৎ এই সরকারের আমলে প্রতি বছর গড়ে ৪০ জন করে নিহত হয়েছে।
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে সীমান্তে নিহত হয় ১৮২ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ৬২ জন এবং ২০০৭ সালে ১২০ জন নিহত হয়।
গত চারটি সরকারের মধ্যে সীমান্তে সবচেয়ে বেশি হত্যা হয় বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। তাদের শাসনামলে ২০০৬ সালে ১৪৬, ২০০৫ সালে ১০৪, ২০০৩ সালে ৪৩, ২০০২ সালে ১০৫ ও ২০০১ সালে ৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরেই নিহত হয় ৪৯৩ জন। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৯ জন।
বিজিবি প্রধান এই হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে তাদের পক্ষ থেকে চাপ অব্যাহত থাকবে বলে জানানোর পর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বিএসএফের মহাপরিচালক শ্রী কে কে শর্মাও। তিনি বলেন, আমরা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নন লিথেল (প্রাণঘাতি নয়) অস্ত্র ব্যবহারের ফলে সীমান্তে প্রাণহানির ঘটনা কমে এসেছে।
তবে নন লিথেল অস্ত্র ব্যবহার করায় অপরাধীদের দ্বারা বিএসএফ সদস্যদের উপর আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিএসএফ প্রধান। জানান, এমন ঘটনায় তিনজন বিএসএফ সদস্য নিহত হয়েছেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, উভয় দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র যাতে অবৈধ অস্ত্র ও মানুষ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বহিরাগতদের প্রবেশের বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে দুইদেশই একমত।
এছাড়া মাদক চোরাচালন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়েও দুই দেশ মতৈক্যে পৌঁছেছে।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আগে বিজিবি ও বিএসএফ এর মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলনের যৌথ আলোচনার দলিল সই করেন বিজিবি ও বিএসএফ মহাপরিচালক।
দলিলে যে বিষয়গুলোতে দুই দেশ একমত হয়েছে তার মধ্যেও আছে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নিয়ে আসা।
এ বিষয়ে বিজিবি মহাপরিচালক আবার বলেন, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করা ও হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক। এ ধরনের মুত্যুর ঘটনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে বিএসএফ কর্তৃক সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও ভারতীয় নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এছাড়া সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থা পরিকল্পনা গ্রহণের উপর জোর দেয় দুই দেশ। এজন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য, জাল ভারতীয় মুদ্রা, স্বর্ণ ও গবাদি পশু পাচার, সীমান্তে কাটাতারের বেড়া ভেঙে ভেলা, ডাকাতি, চুরি ও অপহরণের মতো অপরাধ প্রতিরোধে দুই পক্ষ আক্ষরিক অর্থে ও যথার্থভাবে সিবিএমপি বাস্তবায়ন করতে একমত হয়েছে।
মানবপাচার ও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়েও দুই পক্ষ একমত পোষণ করেছে। যৌথ সক্ষমতা বৃদ্ধি, সংগঠিত অপরাধী চক্রের তথ্য আদান-প্রদান এবং সীমান্তের অপরাধপ্রবণ এলাকায় নরজরদারি বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কথা হয়েছে, এ লক্ষ্যে আন্তঃসীমান্ত অপরাধপ্রবণ এলাকার ম্যাপিং বছরে দুইবার হালনাগাদ করা হবে।
বিএসএফ মহাপরিচালক জানান, ভারতের আগরতলা প্রান্তে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-ইটিপি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের আখাউড়া প্রান্তে বক্স কালভার্টসহ ড্রেইনেজ নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। উক্ত কাজসমূহ বাস্তবায়ন হলে ওই এলাকার পরিবেশগত ঝুঁকি কমে যাবে।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন