দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন সুপার শপ ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে।বিভিন্ন পণ্য কিনতে সুপার শপগুলোতে নগদ অর্থের তুলনায় বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ব্যবহারও বেশ বেড়েছে।একারণেই এটিএম কার্ড জালিয়াতিতে বিভিন্ন সুপার শপ ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোকে বেছে নেয় প্রতারক শরিফুল ইসলাম (৩৩)। টার্গেট করেই সুপার শপ ‘স্বপ্ন’তে বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি নেয় সে।
গ্রাহকদের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করতে চীন থেকে উন্নত প্রযুক্তির একটি হাতঘড়ি ও মিনি কার্ড রিডার আনে এই প্রতারক।
হাতঘড়ি ও কার্ড রিডারের মাধ্যমেই বিভিন্ন এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরি অতঃপর কোটি কেটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক শরিফুল।
সম্প্রতি পাঁচটি ব্যাংকের কার্ড জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর থেকে শরিফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে সিআইডি'র অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতারের পর বুধবার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
স্বপ্ন’র করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সেলস বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মিজানুর রহমান লিটন জানান, স্বপ্ন’তে বেশিরভাগ ট্রানজেকশন এটিএম কার্ডের মাধ্যমে হয়।একারণে শরিফুল স্বপ্ন’কে টার্গেট করে বেছে নিয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘এটা নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা। পুরো ঘটনাটি তদন্তের বিষয়। আসলে ছেলেটা (প্রতারক শরিফুল) কীভাবে এই প্রতারণার কাজ করছে, তা তদন্ত প্রতিবেদন না পেয়ে আগেভাগে বলাটা কঠিন। যেদিন আমরা কাস্টমারের কাছ থেকে অভিযোগ পাই, সেদিনই তাকে এইচআর বিভাগে সংযুক্ত করেছি। ওইদিনের পর থেকে সে মোবাইল ফোন বন্ধ করে ফেলে এবং তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা তার ঠিকানায় লোক পাঠাই। কিন্তু তার দেওয়া ঠিকানাটি ছিল ভুয়া।’
মিজানুর রহমান লিটন বলেন, ‘এঘটনার পর থেকে আমরা বেশ কিছু প্রসেস মেইনটেন করছি। এর মাধ্যমে আমাদের এখানে নিয়োগে অনেকটা পরিবর্তন আসছে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শরিফুল দু’মাস পরপর তার চাকরি পরিবর্তন করতো। সেই সঙ্গে তার বাসাও ঘন ঘন পাল্টাতো। এছাড়া, সে সব ভুয়া তথ্য,নাম, পরিচয় ও ঠিকানা দিয়ে বিভিন্ন সুপার শপে চাকরি নিতো। কোনোটিতেই সে দুমাসের বেশি কাজ করেনি। চীন থেকে অত্যাধনিক প্রযুক্তির হাতঘড়ি ও মিনি রিডার ডিভাইস অর্ডার দিয়ে আনে সে। এটিএম কার্ড তৈরির জন্য চীন থেকে সে ব্ল্যাংক কার্ড আমদানি করে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, হাতঘড়ির পেছনের অংশে এই বিশেষ মিনি কার্ড রিডার লাগিয়ে রাখা হতো। বিল পরিশোধের জন্য ক্রেতারা যখন পজ কাউন্টারে আসতেন, সেখানে এটিএম কার্ড মেশিনে পজ করার আগে কৌশলে তার সঙ্গে থাকা ডিভাইসে রিড করে নিতো। তারপর গ্রাহক যখন পিন নম্বর দিতো কৌশলে সেটিও টুকে নেওয়া হতো এবং বিলের রি-প্রিন্ট দিয়ে ওই কপির পেছনে লিখে রাখতো শরিফুল।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, উদ্ধার করা বিভিন্ন ব্যাংকের এক হাজার ৪০০টি ক্লোন কার্ডের সবগুলো একটি নামে তৈরি করা হয়েছিল। তবে ভেতরে ম্যাগনেটিং চিপসে তথ্যগুলো ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ক্লোন কার্ড তৈরির পর এক ব্যাংকের কার্ড অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথে ব্যবহার করে টাকা তোলার কাজ করতো এই প্রতারক। সে নিজেই জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিল। ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র দিয়ে মোবাইল ফোন ও সিমকার্ড ক্রয়সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতো।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)অর্গানাইজড ক্রাইম টিমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মোল্যা নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতারক শরিফুল ইসলাম চেইন শপ স্বপ্নের বনানী শাখায় কাজ করতো। হাতঘড়িতে থাকা বিশেষ স্ক্যানিং ডিভাইসের মাধ্যমে সে গ্রাহকদের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করতো। এরপর বাসায় গিয়ে তার ল্যাপটপ এবং ডিভাইসের মাধ্যমে কাস্টমারের তথ্যগুলো ভার্জিন কার্ড বা খালি কার্ডে স্থাপন করে ক্লোন এটিএম কার্ড বানাতো। পরে যেকোনও এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিতো।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়,শরিফুল কুষ্টিয়ার বোয়ালিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এসএসসি এবং গাংনি ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করে। ২০০৭ সালে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটিতে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি নিতে যায়। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ফেরত আসে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় তার রাশিয়ান রুমমেট ইভানোভিচের কাছ থেকে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির কৌশল রপ্ত করে শরিফুল। দেশে আসার পর সে বেশ কিছুদিন ম্যানপাওয়ারের ব্যবসাও করে। তবে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় কার্ড জালিয়াতির কাজ শুরু করে শরিফুল। ২০১৩ সালে ব্যাংকে এটিএম কার্ড জালিয়াতির দুটি মামলায় ১৮ মাসের জেলও খেটেছে সে। এরপর কিছুদিন স্টুডেন্ট কনসালটিং ফার্ম খোলে। তাতেও সুবিধা করতে না পেরে আবার জালিয়াতি শুরু করে।
ব্র্যাক ব্যাংকের কমিউনিকেশন অ্যান্ড সার্ভিস কোয়ালিটি বিভাগের প্রধান জারা জেবিন মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাংকের কিছু গ্রাহক আমাদের অভিযোগ করেনযে, তাদের কার্ড থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে তাদের প্রতারিত হওয়ার সত্যতা পাই।সঙ্গে সঙ্গে আমরা গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণও দিয়েছি। এরপর আমরা সিআইডিকে বিষয়টি জানাই। তারা বিষয়টি তদন্ত শেষে আসামিকে গ্রেফতার করে।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর থেকে এপর্যন্ত আমাদের ব্যাংকে ১৬ শতাংশ কার্ড বেড়েছে। এটিএম কার্ডের তথ্য যাতে কেউ ক্লোন করতে না পারে, সেজন্য আমরা গ্রাহকদের ইএমবি টেকনোলোজির (চিপস বেইজড টেকনোলোজি) কার্ড দিচ্ছি। এই চিপযুক্ত কার্ডের তথ্য নকল করা সম্ভব নয়। আর যে কার্ডগুলোতে প্রতারণা হয়েছে সেগুলো সবই ম্যাগনেটিভ স্ট্রেচের কার্ড।’
গ্রাহকদের অনুরোধ জানিয়ে জারা জেবিন মাহবুব বলেন, ‘আপনারা সতর্কতা অবলম্বন করবেন। টেকনোলোজি এগিয়ে যাচ্ছে,অন্যদিকে প্রতারণাও হচ্ছে। মার্চ মাসে আমরা এধরনের ৯টি অভিযোগ পেয়েছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন