ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী বাইপাস অংশে দিন দিন যানজট তীব্রতর হচ্ছে। সপ্তাহব্যাপী টানা যানজটে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। যানজট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ।
সরেজমিন পরিদর্শন, ট্রাফিক, হাইওয়ে পুলিশ, যাত্রী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে যানজট শুরু হয়। শনিবার রাত পর্যন্ত চলে রোববার থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া যানজট বুধবার পর্যন্তও অপরিবর্তিত থাকায় এ মহাসড়কে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
যাত্রীদের অভিযোগ, এ মহাসড়কের মোহাম্মদ আলী থেকে মহিপালের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। এটুকু পথ পাড়ি দিতে সময় লেগে যায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।
বুধবার দুপুরে মহাসড়কের ফতেহপুরে আটকে থাকা চট্টগ্রামগামী প্রিন্স এন্টারপ্রাইজের হেলপার শফিকুর রহমান জানান, কুমিল্লা থেকে তারা ভোর ৭টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসেন। যাত্রীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন।
ফেনীর মোহাম্মদ আলীতে যানজটে আটকা পড়ার পর বেলা ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা গাড়ী থেকে নেমে কুমিল্লায় ফিরে যান। কুমিল্লা থেকে ভোর ৫টায় ছেড়ে আসা তিসা পরিবহনও আটকা পড়ে একই জায়গায়।
ঢাকা থেকে মঙ্গলবার রাতে ছেড়ে আসা কভার্ডভ্যানের হেলপার জসিম জানান, তারা রাতে এসে জগন্নাথ দীঘিতে আটকা পড়ে। সকাল ১০টার দিকে পুরাতন মহাসড়কের দেওয়ানগঞ্জ পার হচ্ছিল তাদের গাড়ি।
যাত্রীরা জানান, ঢাকা থেকে মোহাম্মদ আলী পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছালেও মোহাম্মদ আলী থেকে মহিপাল এই ৬ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সময় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লেগে যায়। অনেকে এখানে গ্রামের বিভিন্ন সড়ক হয়ে গন্তব্যে চলে যান।
সালাহ উদ্দিন নামে ফেনীর এক ব্যবসায়ী জানান, মঙ্গলবার রাতে তিনি ঢাকা থেকে ফেনী আসার পথে চৌদ্দগ্রামের বাতিশায় যানজটে পড়ায় বাস থেকে নেমে যান। ৫শ টাকায় সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে গ্রামীণ সড়ক হয়ে শহরে পৌঁছান। কুমিল্লা ও আশপাশের এলাকায় যাতায়াতে অনেকে মহাসড়কের পরিবর্তে গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করছেন।
হাইওয়ে পুলিশের এক সদস্য জানান, বিকল্প সড়ক ছাড়া মহাসড়কে এ ধরনের নির্মাণ কাজ নজিরবিহীন। ঠিকাদারের অবহেলার মাশুল দিচ্ছে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা। এছাড়া এ মহাসড়কে অনেক ভিআইপিও চলাচল করেন।
এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। ফলে মহিপালে দেশের প্রথম ৬ লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করেও এর সুফল পাচ্ছে না যাত্রী সাধারণ। অনেক সময় যানজট ফ্লাইওভারও ছাড়িয়ে যায়।
ফেনী ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ মীর গোলাম ফারুক জানান, মহাসড়কের ফেনী অংশের প্রায় ২৫ কিলোমিটার জুড়ে এ নিত্য দুর্ভোগ সামলাতে ট্রাফিক ও পুলিশ সদস্যরা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন। বিরামহীন পরিশ্রমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
মহিপাল হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক আবদুল আওয়াল বলেন, মঙ্গলবার থেকেই টানা এ পরিস্থিতি চলছে। মহাসড়কের জগন্নাথ দীঘি থেকে লালপোল পর্যন্ত কচ্ছপ গতিতে চলছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। চার লেনের গাড়ি ফতেহপুরে এক লেনে চলায় যানজট দুইদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া ডাইভার্সন (বিকল্প সড়ক) না করে ফতেহপুরে রেলওয়ে ওভারপাসে কাজ করার কারণে দীর্ঘদিন ধরে মহাসড়কে যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
অপরদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়ক দিয়ে ফেনী শহরের উপর দিয়ে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করা হলেও কিছুদিন পর সড়কটি খানাখন্দে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
একপর্যায়ে বিকল্প সড়কে দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত এসে বিসিক শিল্প নগরী সড়ক দিয়ে আবার মহাসড়ক হয়ে মহিপাল দিয়ে গাড়ি পার হতে হচ্ছে। বিসিক সড়কটির অবস্থাও বেহাল। ফলে একদিকে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন অন্যদিকে সড়কের দুরবস্থার কারণে গাড়ি ধীরগতিতে চলতে হয়। এতে করে যানজট উভয়দিকে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
স্টার লাইন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক জাফর উদ্দিন জানান, মহাসড়কে যানজটের কারণে তাদের নিয়মিত শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। ঢাকা থেকে ফেনী যাতায়াতে ৩ ঘণ্টার স্থলে এখন প্রায় সময় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। রাজধানীর টিটিপাড়া থেকে ভোর ৫টা ২০ মিনিটে ছেড়ে আসা বাস ফেনী পৌঁছে বিকেল ৩টায়।
এতে করে যাত্রীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকরাও ভোগান্তিতে পড়ছেন। একইভাবে পরিবহন মালিকদেরও লোকসান গুনতে হচ্ছে। এছাড়া দুর্ভোগের কথা ভেবে অনেক যাত্রী মহাসড়কের পরিবর্তে রেলে ছুটছেন।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, লোকসানের মুখে ফেনী-কুমিল্লা রুটে যমুনা ও মদিনা বাস সার্ভিস কিছুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
ফেনী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মাহবুবুর রহমান জানান, মহাসড়কে যানজটের কারণে রেলে যাত্রীর চাপ বেড়ে গেছে। আসন না পেয়েও অনেকে দাঁড়িয়ে রেলে যাতায়াত করছেন।
এদিকে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি ফতেহপুর ওভারপাসের নির্মাণকাজের পরিদর্শনকালে বলেছিলেন, ‘ওভারপাসটির কাজ অর্ধেক শেষ হয়েছে। আগামী মাসে এটি অর্ধেক বা দুই লেন খুলে দেওয়া হবে। তখন যানজট কমে যাবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শিপো পিবিএল ওভারপাসটি নির্মাণের দায়িত্ব পায়। একপর্যায়ে চাঁদাবাজির মুখে পড়ে তারা কাজটি শেষ না করে পালিয়ে যায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশনকে ওভারপাসটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৬০ কোটি ৫১ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন