ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করার কিছুক্ষণ পর কারেন্ট চলে যায়, জেনারেটর ছাড়ার পর ভাইঙ্গা পড়ে গেল। নিচে চাপা পড়া ছিলাম, যতক্ষণ জ্ঞান ছিল ততক্ষণের কথা কইতে পারি, তার পরের কথা আর কইতে পারি না।
একদিন একরাত ভেতরে ছিলাম-কে কখন কীভাবে আমাকে উদ্ধার করছে বলতে পারি না। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি মেডিকেলে। কোমরে সমস্যা। অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারি না, পারি না হাঁটতেও। বাসায় বইসা থাকি, কোনো কাজই করতে পারি না বলেন রানা প্লাজা ধসে আহত পোশাক শ্রমিক শিউলি বেগম।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটি দুর্ঘটনার প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্তের কাছে এক আতঙ্কের দিন। তারা ভুলে থাকতে চান, কিন্তু পারেন না। শরীরের আর মনের ক্ষত তাদের মনে করিয়ে দেয় কী একটা দিন তাদের জীবনের সবকিছু বদলে দিয়েছে।
সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে শিউলি বলেন, বিল্ডিংয়ের ভেতরে চাপা পড়ছি-গায়ের ওপর অনেক কিছু পড়ছে। কিছু দেখতে পাই নাই, খুব অন্ধকার ছিল। আমরা বাইরের চিৎকার শুনছি, কিন্তু ভেতর থেকে কত ডাকাডাকি করছি-কেউ শোনে নাই। সিএমএইচ এ ছিলাম ২৫ দিন। সেখানে চিকিৎসার পর নাটোরে চলে যাই গ্রামের বাড়িতে। আড়াই বছর পর আবার ঢাকা আসছি। এখনও ওষুধ খাওয়া লাগে, কিন্তু অতো টাকা কোথায় পাবো, অনেক দামি দামি ওষুধ খাওয়া লাগে। কিছুদিন খাই, আবার বাদ রাখি।
১ হাজার আটশো টাকা ভাড়ায় রুম নিয়ে আবার আবাস গড়েছেন ঢাকায়।। গ্রামে কিছু করে খাওয়ার মতো নেই। তাহলে হয়তো সব কেড়ে নেওয়া ঢাকায় ফিরতাম না-বলেন শিউলির স্বামী গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, দিন মজুরি করি। যেদিন কাজ থাকে সেদিন টাকা পাই, কাজ না থাকলে টাকাও নাই।
সেদিনের কথা বলতে গেলে কষ্ট লাগে, মাথার ভেতরে সমস্যা হয়। গতকালও ওষুধ খেয়ে আজ সুস্থ আছি বলেন ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া নিলুফার বেগম।
তিনি বলেন, পঙ্গু জীবন নিয়ে আর কতটুকু সুখে থাকা যায়। ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা হলে চিকিৎসা করানো যাবে বলা হলেও গত কয়েক বছরে আমার সাড়ে চারলাখ টাকা গিয়েছে। দোকানে কেবল এখন চা আর পান বিক্রি করা হয়। দুই আড়াই লাখ টাকা লোন আছে। নয়মাস একটানা হাসপাতালে। পায়ের রডে ইনফেকশন হয়েছিল। একদিন ওষুধ না খাইলে পায়ের ব্যাথায় ঘুম হয় না, এখন প্রতিদিন দুইশো থেকে আড়াইশো টাকার ওষুধ লাগে, একেকটা ইনজেকশনে খরচ হয় সাড়ে তিনশো টাকা।
নিলুফা বলেন, পায়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে কিডনির সমস্যা। নয়তলা ভবনটা শরীরের ওপর পড়ে ছিল, কেবল আমরাই জানি সেদিনটা কেমন ছিল। যারা বাঁইচা আছি তারা আজীবন ধুঁকে ধুঁকে মরব। তিনি জানালেন, সেদিন তার শরীরের দুইটি মরদেহ পড়ে ছিল। অথচ মৃত্যুর আগেই সেই ছেলেটি তার সঙ্গে কথা বলেছে, আড়াই ঘণ্টা পর সে মারা যায়। কত কান্নাকাটি করছি-খোদা আমাদের বাঁচাও। ওই ছেলেটি বলেছিল, আমি মরে গেলে আমার লাশটা বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছায়ে দেবেন।
নিলুফার বেগম বিমের নিচে চাপা পড়ে ছিলেন সাড়ে নয় ঘণ্টার মতো, ডান পা ভেঙে বাঁকা হয়ে ছিল। পুরো শরীর অবশ ছিল, ডান পায়ে এখনও কোনো সচেতনতা নাই। আমি যে বাইচাঁ উঠবো-এটা জানতাম না। কবরে রাখলেও একটু জায়গা থাকে। কিন্তু ওইখানে কোনো জায়গা ছিল না। দুই পাশে ছাদ আর পায়ের ওপর বীম পড়ে ছিল। কারও হাত, কারও পা, কারও কেবল পোশাক দেখতে পাইছিলাম।
একমাত্র বিলসের সুলতান ভাই (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান আহম্মদ) ছাড়া কেউ পাশে থাকেনি। বলতে বলতে কাঁদেন নিলুফার বেগম। সারাজীবনের জন্য বোঝা হয়ে গেছি। যদি মরে যেতাম তাহলে স্বামী, সন্তান আর মা সুখে থাকত, তারা টাকা পাইত। এ জীবন বড় কষ্টের, বড় যন্ত্রণার-এ কেবল আমরা বুঝি।
একই কথা বলেন উজ্জ্বল দাস। উজ্জ্বল বরগুনার পাথরঘাটা থেকে সাভারে এসেছিলেন কাজের খোঁজে, তারপর রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন সুইং সেকশনে। বীমের নিচে চাপা পরে ছিলেন উজ্জ্বল, কোনোরকমে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু ডান পায়ে বীমের চাপায় ভেঙে যায়, পা ভেঙে ভাঁজ হয়ে পড়েছিল। নড়াচড়ারও কোনো উপায় ছিল না। রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত সেই বীমের নিচে চাপা পড়ে ছিলাম। অনেক চিৎকার করছিলাম, কিন্তু জায়গা ছিল খুব কম, আমাকে উদ্ধার করতে অনেক কষ্ট করতে হইছে। পা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে কোমরেও আঘাত পাই।
দুর্ঘটনার পর প্রথমে এনাম মেডিকেল আড়াই দিন পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে ১৭ দিন থাকার পর বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখানে ছিলাম আড়াই মাস। পায়ে অস্ত্রোপচার করে সেখানে। সিআরপিতে ছিলাম একবছর তিনমাস। সেখান থেকে বেরিয়ে এই দোকান দেই। এখন এভাবেই চলছে, পা নিয়েই বেশি সমস্যা, চিকন হয়ে গেছে, এখনও পায়ে কোনো শক্তি নেই। তাই এখন ইলেক্টিকের দোকান দিয়েছি, কিন্তু সেটা খুব ভালো চলে না-এভাবেই আসলে আমাদের বাঁচতে হবে বলেন উজ্জ্বল, সামনের টেবিলে রাখা কাজে মন দেন। কেবল বলেন, এভাবেই কাটছে আমাদের জীবন-মেনে নিয়েছি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে সাভারের রানা প্লাজায়। ৯তলা ভবনটির পাঁচটি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক মারা যান, আহত হন ২ হাজার ৪৩৮ শ্রমিক। ভবন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ছিলেন ৮১ জন। ঘটনার পাঁচদিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বেনাপোল থেকে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন