বান্দরবানের বাইশারী-ঈদগড়-দোছড়ি এলাকায় বার বার একই কায়দায় অপহরণ হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অসহায়। এই অঞ্চলে যতসব অপহরণ হয়েছে প্রত্যেক ঘটনায় একই কায়দায় হচ্ছে। এতে করে অপহৃতের পরিবার হচ্ছে মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আইনশৃঙ্খলা অবনতির ভার বহন করছে প্রশাসন আর পর পর অপহরণের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হচ্ছে অপহরণকারী চক্রের। যার কারণে চক্রটি অপহরণকে শিল্প হিসেবে নিয়েছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ির দুর্গম মামা ভাগিনাঝিরি এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। জীবিকার তাগিদে বাবার সাথে দুর্গমে তামাক ক্ষেত করেন। ১৭এপ্রিল রাতে তামাক ক্ষেতের খামার ঘরে ঘুমিয়ে পড়লে ৭-৮জনের দুর্বৃত্ত অস্ত্রের মুখে সাইফুলকে তুলে নিয়ে যায়। বাবাকে ছেড়ে দেয়া হয় মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করার জন্য।
অপহরণকারী চক্রটি রাত পার হওয়ার পর পরদিন সকাল ৭.১৫ টায় ০১৮৭৬৭৩১৪৪৯ মুঠোফোন থেকে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে কল করা হয় বাবাকে। পরে মুক্তিপণের টাকার জন্য ০১৮৭৫৮০৯৮৬১ ও ০১৮৬৩০৪৭৩৯২ নাম্বার থেকে অপহৃতের পরিবারে যোগাযোগ চলে।
বিষয়টি পরিবারের পক্ষ থেকে নিকটবর্তী বাইশারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে অবহিত করা হয়। প্রথম দিনেই সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রায় ৬৫ সদস্যের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অপহৃতকে উদ্ধারে অভিযান চালায়। দ্বিতীয়বার বান্দরবান অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আলী হোসেনের নেতৃত্বে এবং তৃতীয় দফায় এআই আবু মুছার নেতৃত্বে অভিযানে পাচঁদিন ধরে খুঁজেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে উদ্ধার করতে পারেনি।
এদিকে পরিবার জানে না সে কোথায় আছে? কেমন আছে? মৃত্যুর ভয় দেখানো হলেও সে যে, বেঁচে আছে তা মোবাইল ফোনে আলাপচারিতায় বুঝতে পারত পরিবার। আধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল ট্র্যাকিং করে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু পাহাড়-জঙ্গলের কারণে অপহরণের পর ব্যবহৃত মোবাইলের সুনির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। দুর্গমে থেকেও অপহরণকারী চক্রটি প্রত্যেক অভিযানের খবর আগাম জেনে অপহৃতকে নিয়ে স্থান পরিবর্তন করে দুর্গমে ঢুকে পড়ে।
সময় পার হওয়ার সাথে সাথেই অপহৃত পরিবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। নানা ভয়ভীতি আর সাইফুলকে হত্যার হুমকির কারণে এক পর্যায়ে অপহরণকারীদের পাতানো ফাঁদে পড়ে পরিবার। বাধ্য হয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অপহৃতের মা খুরশিদা বেগম ও চাচী নগদ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে অপহরণকারীদের কাছে পৌঁছে দেয়। মুহূর্তেই বাইশারী ইউনিয়নের ত্রি স্টার রাবার বাগান এলাকায় ছেড়ে দেয়া হয়।
অপহৃত ব্যক্তি ফিরে আসার পরও থেমে নেই পুলিশের তৎপরতা। জেলা পুলিশের নির্দেশে প্রযুক্তি ব্যবহার এবং গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার রাতে বাইশারী পুলিশের এসআই আবু মুছার নেতৃত্বে অপহরণকারী দলের সদস্য নুরুল হাকিম (৩৫) ও আবদুর রশিদ (৩০) নামে দুই জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে প্রথমজন জিজ্ঞাসাবাদে দুর্ধর্ষ আনোয়ার বাহিনীর সদস্য বলে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
এই প্রসঙ্গে বাইশারী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পক্ষ থেকে একাধিক অপহরণ ঘটনায় পাহাড়ে অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া এসআই আবু মুছা এ প্রতিবেদককে বলেন, মিয়ানমার, রামু উপজেলা ও আলীকদম সীমান্তের মধ্যবর্তী বাইশারী-ঈদগড়-দোছড়ি এলাকাগুলো অত্যধিক দুর্গম আর পাহাড় বেষ্টিত। তাই অপহরণের পর অপহরণকারীরা যেখানে সাধারণ মানুষের বিচরণ নেই সেদিকে দ্রুত এগুলো থাকে। পাহাড় আর জঙ্গলের কারণে অনেক সময় মোবাইল ট্রেকিংও কাজে আসেনা। তবে এই অঞ্চলে অপরাধের সাথে জড়িতদের বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের নখদর্পণে রয়েছে। কয়েকজন দুর্ধর্ষ অপহরণকারীকে আটকও করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অপহরণ, জিম্মায় রাখা এবং মুক্তিপণ তিন ধাপে হয়ে থাকে। অপহরণকারীরা হস্তান্তর করে জিম্মাদারদের। বাইরে থেকে অপর একটি গ্রুপ মুক্তিপন আদায় করে। যেখানে স্থানীয় কিছু অপরাধীও জড়িত। তবে জিম্মাদারা সবাই ভাড়াটিয়া।
শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান, প্রযুক্তি ব্যবহারের পরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অপহৃতদের উদ্ধারে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পেছনে দুর্গম আর পাহাড়ি জঙ্গলই কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টমহল। তাদের মধ্যে যারা অপহরণ করে তারা এই পেশাটিকে শিল্প হিসেবে নিয়েছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন