শুকিয়েছে রক্তের দাগ কিন্তু শুকায়নি চোখের পানি। সেদিন জাতি দেখেছে ইতিহাসে বিবর্জিত এক কালো অধ্যায়, দেখেছে হাজারো লাশের স্তূপ। স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, স্বামী হারিয়েছেন স্ত্রীকে, ভাইকে ফেরত না পাওয়ার বেদনায় কাতর বোন, বোনের লাশের প্রতীক্ষায় ভাই, সন্তানের মৃত্যু শোকে ব্যাকুল মা-বাবা।
ভয়াল সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পঞ্চম বার্ষিকী মঙ্গলবার। চার বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল ২ হাজার ৪৩৮ জনকে।
মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনার পর নির্মম পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয় হাজারো মানুষকে। উপার্জন অক্ষমতা আর মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। যে সহকর্মীদের তারা হারিয়েছেন, তাদের মনে করে এখনো চোখের জল ফেলেন তারা। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে বলেন, ‘মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন সহকর্মীরা’।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পাঁচ বছরেও আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাননি অনেক নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিক। আবার যারা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তাদের চিকিৎসার পেছনেই প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণের চাইতে বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাই অনেকেই অর্থের অভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
তেমনই এক হতভাগ্য শ্রমিক নিলুফা বেগম। রানা প্লাজার পঞ্চম তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে কাজ করতেন তিনি। ভবন ধসে পড়ার সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করা হয়। পিলারের নিচে চাপা পড়ে নিলুফার ডান পা অকেজো হয়ে গেছে। পঙ্গুত্ব বরণ করার পর তিনি এখন সাভারের রাজাশন এলাকায় চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। স্বামী তৌহিদুল ইসলাম সারাদিন দোকান সামলাতে স্ত্রীকে সাহায্য করেন, সন্ধ্যার পর রিকশা চালান।
দীর্ঘ পাঁচ বছরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি নিলুফা। তাই নিজের মৃত্যুকামনা করে জীবনের প্রতিটি দিন কাটাচ্ছেন তিনি। কেমন আছেন প্রশ্ন করতেই নিলুফা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, 'আছি আর কি, যেমন আছি এর চেয়ে ওই দিন মইরা গেলেও মনে হয় ভালো থাকতে পারতাম। যারা মইরা গেছে তারাই বাঁইচ্চা গেছে। প্রতিদিন ওষুধ খাইতে হয়। না খাইলে শরীরে অনেক জ্বালা করে। টেকার লেইগা ওষুধ খাইতে পারি না আইজ ১৫ দিন। শরীরের যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।'
তিনি বলেন, ডান পা হারাইয়া ক্ষতিপূরণ পাইলাম সাড়ে ৫ লাখ টেকা। কিন্তু হেই টেকা চিকিৎসাতেই শেষ হইয়া গেছে। এহন সংসার খরচ, পোলার পড়ালেখার খরচ দিয়া ওষুধ কিনার টেকাডাও থাকে না। অনেকেই আশা দিছিল অল্প টেকায় আমার পা ভালো হইয়া যাইবো। কিন্তু পায়ের পিছে সব টেকা শেষ করলাম কোনো লাভ হইলো না।
কান্না জড়িত কণ্ঠে নিলুফা বলেন, ৫ বছর হইলো, কিন্তু আমরা কোনো বিচার পাইলাম না। পঙ্গু হইয়া স্বামী পোলাপাইন লইয়া কষ্টে দিন কাটাইতাছি। এর লেইগা ওই রানা দায়ী। আমরা রানার বিচার চাই। খালি দোয়া করি বাঁইচ্চা থাকতে যাতে ওর বিচার দেইখা যাইতে পারি।
নিলুফার স্বামী তৌহিদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, চা-পানের দোকান দিয়ে কোনো রকম চলে। সারা দিন আমি নিলুফারে দোকান চালাইতে সাহায্য করি। সন্ধ্যায় রিকশা চালাই। ১১ বছরের ছেলে রিফাত বর্ণমালা স্কুলে পড়াশোনা করে। ঠিক মতো ওর পড়াশোনার খরচ দিতে পারি না।একবেলা রিকশা চালাইয়া আর চা বিক্রি কইরা যা পাই তাই দিয়া কোনো রকমে চলতাছি।
রানা প্লাজা ট্যাজেডিতে নিলুফার মতো পায়ে আঘাত পান আরতি রানী দাসও। ওই ভবনের সপ্তম তলায় নিউ স্টাইল গার্মেন্টসের প্রিন্ট সেকশনে কাজ করতেন আরতি। দুর্ঘটনার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। পাঁচ বছরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলেও ভয়াল ওই স্মৃতি মনে পড়লে আজো আঁতকে উঠেন তিনি।
সে দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আরতি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, কেন যে ওই ভবনে কাজে গেছিলাম। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে ভবন ধস হয়। আমি ওই মাসেরই ১ তারিখে চাকরিতে জয়েন করি। ঘটনার দিন সকাল ৮টার দিকে কাজে যাই। ৯টার দিকে প্রচণ্ড শব্দ। এরপর আর কিছু মনে নাই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেহি দুইডা লাশ আমার পায়ের উপর। লাশ দুইটা একটা পিলারে চাপা পড়ছিল আর তার নিচে আমার পা। তিন দিন পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পিলার আর লাশ সরিয়ে আমাকে উদ্ধার করে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর ১০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন আরতি। চিকিৎসা শেষে শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়ার পর মামুন মিয়া নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী আর দুই বছরের ছেলে সিয়ামকে নিয়ে সাভারেই থাকছেন আরতি। তার স্বামী মামুন নৌকা চালান। কষ্ট করে কোন রকমে কাটছে তাদের দিন।
রানা প্লাজার ৮ তলায় নিউওয়েভ ফ্যাশনে কোয়ালিটি সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন মাহমুদ হাসান হৃদয়। রানা প্লাজা ধসে তার পাঁজর ভিতরে ঢুকে যায়, ভেঙে যায় মেরুদণ্ড। ডান পাও অকেজো হয়ে গেছে। সাভারে ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন হৃদয়, দুর্ঘটনার পর তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছেন।
হৃদয় বলেন, পাঁচ বছরেও সুস্থ হতে পারলাম না, এখনো চিকিৎসা চলছে। থেরাপি নিতে হচ্ছে। প্রতি থেরাপিতে ১ হাজার টাকা লাগে কিন্তু সরকার থেকে কোনো সাহায্য পাই না৷ আগে সভারের সিআরপি এবং ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা পেতাম৷ এখন আর পাই না৷ তারা বলেন ফান্ড শেষ হয়ে গেছে৷ ভাইয়ের খরচে চলি, কাজ করার ক্ষমতা নেই। এখন আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন