মাত্র ৯ বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় হারান দুই পা ও ডান হাত। ১৩ বছর বয়সে হারান বাবাকে। ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাসের মাস কয়েক পর ‘দূর দেশে’ হারিয়ে যান বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার টানতে থাকা মা। গাঁয়ের লোকজন মিলে কৈশোরেই একমাত্র বোনকে বিয়ে দিলেও ‘যৌতুকের চাহিদা’ মেটাতে না পারায় সেই বোন ফিরে আসে তার ঘরে, সঙ্গে ফুটফুটে এক ভাগনেও।
পুরো জীবনটাই যেন ‘হারানো’ বা ‘হার’র গল্প তার। কিন্তু এতো ‘হারানো’র পরও হেরে যাননি নওগাঁর যুবক আলীরাজ। বেঁচে থাকা জীবনের সম্বল বাঁ হাতখানি নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধ। চলছেন নিজে, টানছেন বোন আর ভাগনের জীবনও।
রাতে রাজধানীর মিরপুরের সড়কে দেখা হলো আলীরাজের সঙ্গে। বেঁচে থাকার জন্য এক হাতেই অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি। পদে পদে ‘আঘাত’ পাওয়ার হয়তো আক্ষেপ আছে, কিন্তু দুর্বলতার লেশমাত্র নেই চোখেমুখে। যাত্রী নামিয়েই কথা বললেন বাংলানিউজের সঙ্গে। যেন কোনো ট্র্যাজেডি সিনেমার চেয়েও বেশি সংগ্রামী জীবনের গল্প।এক হাত নিয়ে ঢাকার রাজপথে যাত্রী পরিবহন করছেন অটোরিকশাচালক আলীরাজ। ছবি: জিএম মুজিবুরনওগাঁর মান্দা থানার কাঞ্চন বাজারে তাদের বাড়ি। বাবা মরহুম মোহাম্মদ মোল্লা ছিলেন দিনমজুর। অন্যের ক্ষেতে-খামারে কাজ করে দুই সন্তান মিলিয়ে চার জনের সংসার চালাতেন। স্বপ্ন দেখতেন, আলীরাজকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন। পড়ানোও হচ্ছিলো তাকে। কিন্তু নয় বছর বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে গাছের ডালে বেঁধে যাওয়া ঘুড়ি ছাড়াতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শকে দুই পা ও এক হাত হারাতে হয় আলীরাজকে।
স্বপ্ন দেখা থামাননি বাবা। পড়াচ্ছিলেন আলীরাজকে। কিন্তু ১৩ বছর বয়সে বাবাই চলে যান না ফেরার দেশে। বাবার স্বপ্ন লালন করে এগোতে থাকেন আলীরাজ, বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে সংসার টানতে থাকেন মা। এরমধ্যেই এলাকার কাঞ্চন দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি (১৯৯৯) পাস করেন। মায়ের কষ্ট হলেও স্বপ্ন ছিল ডিগ্রি পাস করে চাকরি করবেনআলীরাজ। কিন্তু হলো না। মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের ভারে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আলীরাজের এসএসসি পাসের কয়েক মাস পর তিনিও দুই ভাই-বোনকে এতিম করে বিদায় নেন দুনিয়া থেকে।
তবু পড়াশোনা করতে চাইছিলেন তিনি। পাশাপাশি ছোট বোনের পড়াশোনা করাতে থাকেন। বোনের বয়স ১৫ পেরোতেই গ্রামের সবাই মিলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু সেখানেও হারতে হলো আলীরাজকে। তিন বছরের মাথায় বোনের সংসার ভেঙে যায় যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পারায়। বোন এক বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসে পঙ্গু ভাইয়ের ঘরে। এক হাত নিয়ে ঢাকার রাজপথে যাত্রী পরিবহন করছেন অটোরিকশাচালক আলীরাজ। ছবি: জিএম মুজিবুরদিশেহারা পরিস্থিতি তৈরি হলেও আলীরাজ যে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে বোন-ভাগনেকেও। গাঁয়ে রোজগারের পথ না থাকায় চলে আসেন ঢাকায়। এসেই ঘুরতে থাকেন। মেলে না কোনো কাজের সন্ধান। অবশেষে একদিন চাকরি হয় একটি মোমবাতি তৈরির কোম্পানিতে। মাসিক বেতন ৬ হাজার টাকা। আলীরাজ ভেবে পান না, নিজে চলবেন কিভাবে, বাড়িতে বোন-ভাগনের খরচ চালাবেন কিভাবে!
উপায় না পেয়ে এই বেতনেই চাকরি শুরু করেন। তবে আরও ভালো কিছু করার পথ খোঁজেন আলীরাজ। এরমধ্যে তার দেখা হয় মিরপুরের পঙ্গু অটো রিকশাচালক কাজলের সঙ্গে। তিনি আলীরাজকে পরামর্শ দেন, তার মতো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতে? কিন্তু টাকা কোথায়? একটা অটোরিকশা নিতে তো ৪০-৫০ হাজার টাকা লাগবে।
বাড়তি কাজ করে কষ্টে-শিষ্টে খেয়ে-না খেয়ে আলীরাজ টাকা জমানো শুরু করেন। শুরু করেন অটোরিকশা নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। বছরখানেকের মাথায় হয়ে যায় আলীরাজের রিকশা নেওয়ার টাকা। এই রিকশা নিয়ে ‘রাজ’ রাজপথে শুরু করেন তার নতুন জীবন। এখন প্রতিদিন ৭-৮শ’ টাকা আয় হয় তার। বোন এবং বোনের ছেলের পড়াশোনা ও সংসার সাজাতে চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলস পরিশ্রম।
আত্মোন্নয়ন বিষয়ক খ্যাতিমান বক্তা সোনিয়া রিচোত্তি বলেছিলেন, ‘যা ঘটেছে তা ভুলে যা আছে তা নিয়ে যা হবে তার ওপর বিশ্বাস করে এগিয়ে চলুন।’ ব্রিটেনের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘আপনাকে যদি নরকের মধ্য দিয়েও চলতে হয়, এগোতে থাকুন।’
আর আলীরাজের কথা, ‘পঙ্গু হয়েও জীবনের কাছে হার মানিনি আর বাকি জীবনও মানবো না ইনশাল্লাহ। আসলে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো আনন্দ আর কোনো কিছুতে নেই। কেবল একটু চেষ্টা করলেই জীবন খুব সহজ।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন