রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ ও মৃতদেহগুলোর মধ্যে ১০ ঘণ্টা আটক থাকা নিলুফারের জন্য ছিল নরকের মতো। আর গত পাঁচ বছর ধরে ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা তার জন্য এখন আরো দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধ্বংসের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারখানা দুর্ঘটনার একটি সাভারের এই গার্মেন্টস ধস। এক হাজার ১৩০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল ওই দুর্ঘটনায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। নিম্ন মজুরির কারণে বাংলাদেশে অর্ডার দেয়া বাতিল করে পশ্চিমা অনেক দেশ।
কিন্তু এখনো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রায় দিতে পারেনি আদালত। নিলুফার জানান, ধ্বংসস্তূপ ও মৃতদেহের চাপে ডান পা হারাতে হয়েছে তাকে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছিল তিন লাখ টাকা। কিন্তু চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে তার দ্বিগুন। আত্মীয়-স্বজন থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়েছে নিলুফারকে।
তিনি বলেন, ‘আমি মৃত্যুর ক্ষণ হিসেব করছিলাম। আমার পায়ের মাংসপেশী ছিড়ে গিয়েছিল। আমার কিডনি নষ্ট হয়ে যায় ওই ঘটনায়।’
তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া নয় তলা রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছিল। নিলুফারের মতো এমন গল্প তাদের প্রত্যেকের।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের তথ্যমতে, অনেকেরই পুরো ক্ষতিপূরণের অর্থ চলে গিয়েছে শুধু চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে। নিলুফার জানান, এখন শুধু ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।
ভুক্তভোগী এই নারী বলেন, ‘আমরা কেউ সেদিন কারখানায় ঢুকতে চাইনি। আগেরদিন পিলার নড়বড়ে হয়ে থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের কারখানায় ঢুকতে বাধ্য করে। পাঁচ বছরে হয়ে গেল, কিন্তু কারো বিচার বা সাজা হলো না।’
১১ বছরের এক সন্তানের মা নিলুফার আরো বলেন, ‘ভবনের মালিক জেলে খুব ভালো সময় কাটাচ্ছে। বাকি সব অভিযুক্ত জামিনে বাইরে আছে। কাজ না করলে গুলি করা হবে- আমাদের এমন হুমকি দিয়েছিল যে কারখানা মালিক ও ম্যানেজার, তারা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা অনেকেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছি। কিন্তু সবাই আজ আমাদের ভুলে গেছে।’
ভুক্তভোগী নিলুফার
রানা প্লাজার ঘটনার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়। প্রিমার্ক, ম্যাঙ্গো ও বেনেটনের মতো ইউরোপীয় ও মার্কিন পোশাক ব্র্যান্ডগুলোকে চাপ দেয়া হয় বাংলাদেশের কারখানার কাজের পরিবেশ উন্নত করা ও বেতন কাঠামো বাড়ানোর জন্য। বর্তমানে বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের মাসিক বেতন পাঁচ হাজার টাকার মতো, যা কমের দিক থেকে বিশ্বে অন্যতম।
১০০ ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত কারখানা পর্যবেক্ষণকারী একটি গোষ্ঠী অবশ্য বলেছে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর মান উন্নত হয়েছে। গত বছর এ খাতে ২০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।
যদিও শতাধিক ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি গোষ্ঠী সতর্কতা দিয়েছে। তারা বলেছে, এখনো ৪৫০০ এমন পোশাক শিল্পে বড় ধরনের জীবনের প্রতি হুমকি আছে।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও অভিযুক্ত অন্য ৪০ জনের বিচার প্রক্রিয়া যে গতিতে চলছে, তার চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে চলছে অবস্থার উন্নয়ন। দুদকের মামলায় ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ প্রকাশে ব্যর্থ হওয়ায় গত বছর আগস্টে সোহেল রানাকে তিন বছরের জেল দেয়া হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও আছে।
এ মামলার প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে তাতে আইনজীবীরা বলছেন, রায় ঘোষণা হতে আরো পাঁচ বছর লাগতে পারে। এক্ষেত্রে বার বার মুলতবি করে দেয়াকে দায়ী করেন বাদী পক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান।
এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দেননি। এরই মধ্যে অনেক সাক্ষী লাপাত্তা হয়ে গেছেন। এদিকে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, যে ধীরগতিতে মামলা চলছে তাতে দায়মুক্তির একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিক অধিকার আদায়ের শীর্ষ স্থানীয় নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি শ্রমিকদের ইউনিয়নভুক্ত হতে সহায়তা করবে। তারা এক হয়ে তাদের উন্নত অধিকার আদায়ের দাবি তুলবে। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো প্রতিবাদ বিক্ষোভের আভাস পেলেই কারখানা মালিকরা স্থানীয় গুণ্ডা, পুলিশ ব্যবহার করে। সরকার দমন-পীড়ন চালায়।’
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বেতনের বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করছিল, তখন মোহাম্মদ ইব্রাহিমসহ ৪১ নেতাকে আটক করা হয়েছিল। ইব্রাহিম জানান, পুলিশ তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। তার মতে, প্রায় ১৭০০ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদের আর চাকরিতে নেয়া হয়নি।
রানা প্লাজা নিয়ে সবচেয়ে ভালো প্রতিবেদন করেছেন সাংবাদিক নাজমুল হুদা। তার তৈরি প্রামাণ্যচিত্র ওই দুর্ঘটনার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ। ‘শ্রমিকদের উস্কে দেয়ার’ অভিযোগে তাকে ৪২ দিন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। বর্তমানে দেশ ছাড়তে চাইছেন এই সাংবাদিক।
তিনি বলেন, ‘চোখ বেধে পুলিশ আমাকে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যায়। আমি রডের মতো কিছু একটা সেখানে আছে বুঝতে পারলাম। পরে তারা আমাকে লাঠি দিয়ে প্রহার করতে শুরু করে।’
নাজমুল আরো বলেন, ‘তারা আমার মাথায় আঘাত করে। পিস্তলের বাট দিয়ে কানে আঘাত করে। আমি এখন ডানকানে প্রায় শুনতেই পাই না।’
পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, নাজমুল তথ্যপ্রযুক্তি আইন ভঙ্গ করেছেন। সেজন্যই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন