স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের সঙ্গে আলোকচিত্রী এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন। এর মধ্যে শুধু স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি বেঁচে আছেন। বাবা-মেয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ছবি : সংগৃহীত
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামের বাড়িতে নিজের খুব প্রিয় একটি বাগান ছিল প্রিয়কের। বাড়ির ব্যালকনি থেকে দেখা যেত একটি ডালিম গাছ। এই জায়গাটিও অসম্ভব পছন্দ করতেন তিনি। আর এখানেই শায়িত হলেন এই আলোকচিত্রী। শায়িত করা হলো তাঁর ছোট্ট মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী তামাররাকেও।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয় এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন ও তাঁর শিশুকন্যা প্রিয়ন্ময়ী তামাররাকে।
এ সময় জানাজায় অংশ নিতে আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষের ঢল নামে।
প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগমের ইচ্ছে ছিল, বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যাতে জীবনের বাকিটা সময় ছেলে ও নাতনির কবর দেখে এবং দোয়া করে সময় কাটাতে পারেন- আর তাই এখানেই হলো তাদের শেষ শয্যা।
এমনকি পারিবারিক কবরস্থানে আগেই দাফন হওয়া প্রিয়কের বাবার কবরও খুব তাড়াতাড়ি এখানে স্থানান্তর করা হবে। এ ছাড়া প্রিয়কের এই তিনতলা বাড়ির নিচ তলায় বসার ঘরটিতে সংরক্ষণশালা করা হবে। প্রিয়কের বিভিন্ন শিল্পকর্মসহ তাঁর স্মৃতিবিজড়িত জিনিসগুলো রাখা হবে এখানে।
গাজীপুরের শ্রীপুরে গ্রামের বাড়িতে আজ মঙ্গলবার প্রিয়ক ও তাঁর মেয়ের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : এনটিভি
নিহত প্রিয়কের জেঠাতো ভাই লুৎফর রহমান জানান, নেপালে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত দেখা ও বিদেশ ভ্রমণের জন্য নগর হাওলা গ্রামের আলোকচিত্রী এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন তাঁর তিন বছরের একমাত্র সন্তান প্রিয়ন্ময়ী তামাররা ও স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানিকে নিয়ে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজে চড়ে গত ১২ মার্চ নেপালের উদ্দেশে রওনা হন। একই উড়োজাহাজে চড়ে ফারুকের মামাতো ভাই ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান অমিত ও মেহেদীর স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণাও বেড়াতে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাঁদের পাঁচদিনের সফর শেষ করে গত শুক্রবার দেশে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের সেই আনন্দ সফর পরিণত হয়েছে বিষাদে। ১২ মার্চ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নেপালেই নিহত হন ফারুক ও তাঁর মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী। অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া অ্যানি, মেহেদী ও স্বর্ণাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে নেপালের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চারদিন চিকিৎসার পর গত শুক্রবার প্রিয়কের স্ত্রী অ্যানী, মেহেদী ও মেহেদীর স্ত্রী স্বর্ণাকে নেপালের হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তবে জীবিত ফিরে আসেননি প্রিয়ক ও তাঁর শিশুকন্যা প্রিয়ন্ময়ী। অ্যানিকে এত দিন স্বামী ও মেয়ের মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়নি। গতকাল ঢাকা মেডিকেল থেকে ছুটি নেন আহতরা।
গতকাল বিকেলে প্রিয়ক ও প্রিয়ন্ময়ীসহ ২৩ বাংলাদেশির লাশ দেশে নিয়ে আসে সরকার। এরপর আর্মি স্টেডিয়ামে তাঁদের জানাজা শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
লুৎফর রহমান জানান, প্রিয়ক ও তাঁর মেয়ের জানাজা আজ সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় আবদুল আউয়াল কলেজ মাঠে এবং বেলা ১১টার জৈনাবাজার এলাকার মাদবরবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এ কলেজেই প্রিয়ক লেখাপড়া করেছেন। জানাজার আগে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদনের জন্য সকাল ৮টার দিকে ওই কলেজের শহীদ মিনার পাদদেশে নিহতদের কফিন রাখা হয়। এ সময় প্রিয়কের সহপাঠী, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনসহ এলাকাবাসী তাদের শ্রদ্ধা জানায়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেহেনা আক্তারসহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। জানাজায় আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়।
জানাজা শেষে তাদের লাশ নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসায় এনে শেষবারের মতো স্বজনদের দেখানো হয়। এ সময় স্বামী-সন্তানের লাশের পাশে প্রিয়কের স্ত্রী অ্যানিসহ স্বজনরা বুক ফাটা আহাজারি করতে থাকেন। স্বজনদের আহাজারিতে হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে প্রিয়কের মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী বাসার সামনে ব্যালকনির পাশে প্রিয়কের প্রিয় ফুলের বাগানে ডালিম গাছের পাশে প্রিয়ক ও তাঁর মেয়েকে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়। এ বাগান ও বাসাটি প্রিয়কের বেশ প্রিয় ছিল।
এর আগে গতকাল সোমবার রাত ৮টার দিকে বাবা-মেয়ের লাশ দুটি পৃথক কফিনে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসায় আনা হয়। নিহতদের লাশ বাড়িতে পৌঁছার খবর পেয়ে তাঁদের স্বজন ও এলাকাবাসী প্রিয়কদের বাড়িতে ভিড় জমায়। এ সময় অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আজ বাবা-মেয়েকে দাফনের আগে অ্যানিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আসেন স্বজনরা। এ সময় অ্যানি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বারবার মূর্চ্ছা যেতে থাকেন। স্বজনরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও তাঁরা হারিয়ে ফেলেন। অপরদিকে পুত্র শোকে প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগম অনেকটা পাথর হয়ে যান। মাঝেমধ্যে তিনি ছেলে ও নাতনির কফিনের পাশে গিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন। অ্যানি ও প্রিয়কের মায়ের আহাজারিতে পুরো এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দাফন কার্যক্রম শেষে চিকিৎসার জন্য অ্যানিকে আবার কাল ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় আহত অ্যানিকে নেপালে কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চারদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে গত শুক্রবার তাঁকে দেশে এনে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তিনি মানসিকভাবে যেন ভেঙে না পড়েন সেজন্য স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়নি তাঁকে। নিহত স্বামী ও সন্তানের লাশ সোমবার দেশে আনা হলে তাঁদের মৃত্যুর সংবাদ জানানোর জন্য স্বজনরা অ্যানিকে বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। অ্যানির ডান গোড়ালিতে ব্যথা রয়েছে, কিন্তু হাড় ভাঙেনি, লিগামেন্টে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তিনি এখন মোটামুটি ভালো আছেন। তবে যেহেতু তাঁর স্বামী ও সন্তান মারা গেছে, তাই তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। হাসপাতালে তিনি বারবার তাঁর মেয়ের খোঁজ করছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন