জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক উপ-উপাচার্য নাটক ও নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমদের বিরুদ্ধে গর্ভপাতে বাধ্য করা, সন্তানকে অস্বীকার ও হত্যার হুমকির অভিযোগ এনেছেন বিভাগের সাবেক এক ছাত্রী।
অভিযুক্ত অধ্যাপকের তালকপ্রাপ্ত দ্বিতীয় স্ত্রী দাবিদার ওই ছাত্রী নিজেও দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
নাট্য জগতে পরিচিত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আফসার সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের প্রশাসনে উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক রাজনীতিতে রয়েছে তার প্রভাবশালী ভূমিকা।
গত ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বরাবরে লিখিত অভিযোগ ওই ছাত্রী বলেন, ‘স্নাতক সম্মান প্রথমবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় কলা ও মানবিক অনুষদে প্রথম স্থান অর্জন করলে অধ্যাপক আফসার ওই ছাত্রীকে খুঁজে বের করে পরিচিত হন। পরে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলে কোর্স শিক্ষক হিসেবে তার সঙ্গে পুনরায় পরিচয় হয়। স্নাতক সম্মানে ভালো রেজাল্ট করলে ওই শিক্ষক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে অত্যন্ত সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ধারণা দেয় এই ছাত্রী তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের একজন। তার স্ত্রীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়ে ওই অধ্যাপক ছাত্রীর কাছে ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন হতাশার কথা শেয়ার করে।’
ওই ছাত্রী বলেন, ‘আফসার আহমদের অসহায়ত্বের কথা জেনে একসময় তার প্রতি আমার একধরণের মায়া জন্মায়। আর সেই মায়াকে কাজে লাগিয়ে সে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে একপর্যায়ে প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০১৫ সালের নভেম্বরের মধ্যেই স্ত্রীর সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হবে বলে জানায়। এরপর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই- আমার মধ্যে এরকম বিশ্বাস তৈরি করে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর শরিয়ত মতে সে আমাকে বিয়ে করে।’
তিনি বলেন, আগের স্ত্রীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার আশঙ্কায় অভিযুক্ত শিক্ষক আফসার আহমদ বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ করে। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তঃসত্ত্বা হলে অধ্যাপক আফসার গর্ভের সন্তানটি প্রতিবন্ধী হতে পারে এরকম কথা বলে তাকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করায়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হলে এই অধ্যাপক অভিযোগকারী ছাত্রীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এবং তার প্রথম স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখেন।
ওই ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে সে আমাকে বলেছে যে সে কিছুতেই এ বাচ্চা জন্মাতে দেবে না। যদি জন্মায়ও, আমি যদি ডিএনএ টেস্ট করাই তাহলেও তার ক্ষমতাবলে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট মিথ্যা বলে প্রমাণ করবে। এমনকি আমার সঙ্গে বিয়েটাও মিথ্যে প্রমাণ করে দেবে। অতঃপর আমাকে ও আমার গর্ভের সন্তানকে হত্যার হুমকিও দেয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রাণভয়েঅন্তঃসত্তা অবস্থায় আমি আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হই। এরপর আত্মীয়-পরিজনহীন অনিরাপদ পরিবেশে ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। এর ঠিক দুই দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর সে আমাকে তালাকের নোটিশ পাঠায়।
ভুক্তভোগী এই ছাত্রী বলেন, ‘সে এবং তার পরিবারের সদস্যরা নানামুখী হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। সে আমার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংসহ আমার গতিবিধির ওপর নজরদারি করছে।’
তিনি আরও বলেন, সম্পর্কের শুরু থেকেই আফসার আমার সাথে প্রতারণা করেছে যা আমি তখন বুঝতে পারিনি। তার চাকরি জীবনে এরকম আরও অনেকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে প্রতারণা করেছে বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।
অভিযোগকারী ছাত্রী বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকের প্রথম স্ত্রী এবং জামাতা আত্মীয়দের জোর দেখিয়ে অভিযোগকারী ছাত্রীকে গুম করে ফেলবে, খুন করে ফেলবে, পুরো পরিবারকে জঙ্গি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে বলে হুমকি দেন।
এছাড়া ছাত্রীর বোনের ছেলে-মেয়েকে ধরে নিয়ে যাবে, বোনের মেয়েকে পুলিশের কাস্টডিতে ধর্ষণ করাবে, পরিবারের চাকরিরত সদস্যদের চাকরিচ্যুত করবে, অভিযোগকারীকেও চাকরিচ্যুত করাবে এবং কিছুতেই যদি কাজ না হয় তাহলে অধ্যাপক আফসারের তার ভিডিও ওই জামাতা ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দেন বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন।
ওই ছাত্রী বলেন, ‘আফসার আমার সঙ্গে সংসার করার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং সে প্রথম থেকেই জানত যে সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে। বিধিমতে প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় সে তা গোপন করে কিংবা তার অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে না। সে আমার একার সাথেই প্রতারণা করেনি, আমার জানা মতে আরও অনেকের সাথেই করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এভাবে কেউ না কেউ তার প্রতারণার শিকার হয়েই যাচ্ছে। এটি সুস্পষ্ট পেশাগত অসদাচরণ। আফসার আহমদ এর মতো শিক্ষক যতদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে প্রতারণা চালিয়ে যেতে পারবে, ততদিন আরও অনেকেই প্রতারণার শিকার হবে।’
ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ‘আফসার আহমদের কারণে আমার ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ও শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার প্রতারণার শিকার না হলে আমার জীবন অন্যরকম হতে পারতো।’
উপাচার্যের কাছে বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি অধ্যাপক আফসার আহমদের নৈতিক স্খলন ও অসদারচরণের জন্য তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ শাস্তি দাবি করছি। ভবিষ্যতে যেন কোনো শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
অভিযোগের সত্যতা জানতে চেয়ে পরিবর্তন ডটকমের এ প্রতিবেদক ফোন করলে অধ্যাপক আফসার আহমদ জানান তিনি রিহার্সেলে ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন।
পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করলেও অধ্যাপক আফসার তা রিসিভ করেননি। মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে অভিযোগ হস্তান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সেল কাজ করছে। উনারা ডিসিশন নিবেন।’
এদিকে রোববার যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে অভিযোগটি হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই সেলের প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতার পরিবর্তন ডটকমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু অভিযোগটি যেহেতু সিলগালা করা এবং কমিটির উপস্থিতি ছাড়া খোলা যাবে না তাই আমি এখনও বিস্তারিত জানিনা কী অভিযোগ। কালকে কমিটি বসবে, তখন জানা যাবে কী বিষয়ে অভিযোগ।’
অধ্যাপক রাশেদা আরও বলেন, ‘আগে আমাদের বুঝতে হবে এটা যৌন নিপীড়নের মধ্যে পড়ে কিনা। যৌন নিপীড়নের মধ্যে পড়লে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।’
এদিকে অভিযোগকারী ছাত্রী অধ্যাপক আফসারের অধীনেই পিইচডি গবেষণা করছেন বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, অধ্যাপক আফসারও যদি দাবি করেন এই ছাত্রী তার স্ত্রী ছিলেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী স্ত্রী তো স্বামীর অধীনে পিএইচডি গবেষণা করতে পারেন না। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ থাকলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক পরীক্ষা কমিটিতেই থাকতে পারেন না।’
অভিযোগ সংক্রান্ত সকল তথ্য-প্রমাণ পরিবর্তন ডটকমের হাতে রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন