রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এসিআই গ্রুপের রিটেইল চেইন শপ স্বপ্নের বিভিন্ন আউটলেটে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন ৬৮ জন ব্যক্তি। অভাবের তাড়নায় দিনের অর্ধেক সময় ধরে অমানবিক পরিশ্রম করে চাকরির শেষ মাস ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এক টাকাও বেতন পাননি তারা। স্বপ্নের মাতৃ প্রতিষ্ঠান এসিআই গ্রুপ ঠিকই বেতন দিয়েছিল তাদের। কিন্তু এসিআইয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ কামাল হোসেন তাদের সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এসিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া নথি অনুযায়ী, রাজ এন্টারপ্রাইজের মালিক কামাল হোসেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এক মাসের বেতন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৭৮২ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
বহু পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেতনের এই টাকা কেন দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে কামাল হোসেন বলেন, ‘এসিআই গ্রুপ বিল করেনি। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি।’
তবে এসিআই গ্রুপের কাছ থেকে কামাল হোসেনের টাকা নেওয়ার প্রমাণ প্রিয়.কমের কাছে আছে। ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি এসিআই গ্রুপের কাছ থেকে বিল নেন রাজ এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী কামাল। সেই বিলে কামালের স্বাক্ষরও রয়েছে।
এসিআই গ্রুপের কাছ থেকে কামাল হোসেনের টাকা নেওয়ার রশিদ। ছবি: প্রিয়.কম
২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের ওই বিলে দেখা যায়, স্বপ্নের মিরপুর ১২ নম্বরে অবস্থিত আউটলেটে পাঁচজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১১৪ দিন, গ্রিন রোডের ১২ জন ৩৭০ দিন, মিরপুর ৬ নম্বরের চারজন ১১৫ দিন, মিরপুর ১ নম্বরের ১৭ জন ৫৭০ দিন, নতুন বনানীর সাতজন ২৫২ দিন, পুরাতন বনানীর ১২ জন ৪২৮ দিন, কাদেরিয়া হাউজিংয়ের পাঁচজন ১৯১ দিন, পশ্চিম কাফরুলের চারজন ১২০ দিন এবং কাজীপাড়ায় ২-এর দুজন ৭২ দিন কাজ করেন। স্বপ্ন আউটলেটের এই নয়টি পয়েন্টে ৬৮ জন কর্মীর মোট বিল করা হয় ৭ লাখ ২৬ হাজার ৭৮২ টাকা।
২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এসিআই গ্রুপের সঙ্গে সব কর্মকাণ্ড গুটিয়ে আনার সময় লিখিত দেন কামাল হোসেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘মেসার্স রাজ এন্টারপ্রাইজ আপনাদের সাথে বিশ্বস্ততার সহিত দীর্ঘদিন ক্লিনিং কাজ করে আসছে। এসিআই গ্রুপের প্রয়োজনে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের পর সব কর্মকাণ্ড বন্ধের কথা বলা হয় এবং আমরা সমন্বয় করে দিই। তা ছাড়া ডিসেম্বর-২০১৬ মাসের বিল পরিশোধের পর মেসার্স রাজ এন্টারপ্রাইজের সাথে এসিআই গ্রুপের আর কোনো দেনা/পাওয়ার সম্পর্ক বাকি রইল না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপ্নের ম্যানেজার (ইন্টারনাল অপারেশন) হিল্লোল মাশরেকী বলেন, ‘আমরা রাজ এন্টারপ্রাইজকে সব বিল (টাকা) দিয়ে দিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক কামাল হোসেনকে আমরা বলেছিলাম সব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের যেন বেতন ঠিকমতো বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
এসিআই গ্রুপের সঙ্গে কামাল হোসেনের সব দেনা/পাওনা বুঝে পাওয়ার নথি। ছবি: প্রিয়.কম
এ বিষয়ে এসিআই গ্রুপের কর্মকর্তা দেবু বলেন, ‘রাজ এন্টারপ্রাইজ আমাদেরকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিত। আমাদের চুক্তি থাকত তৃতীয় পক্ষের (রাজ এন্টারপ্রাইজ) সঙ্গে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো রকম লেনদেনের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তৃতীয়পক্ষ নানা রকম ঝামেলা করায় আমরা ২০১৭ সাল থেকে নিজেরাই পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিই। ফলে রাজ এন্টারপ্রাইজের দেওয়া পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন প্রতিষ্ঠানটিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
বেতন না-পেয়ে অন্ধকার দেখছেন তারা
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এসিআই নিজেরা পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিলে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ৭০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী বেকার হয়ে যায়। রাজ এন্টারপ্রাইজ অন্য কোথাও নিয়োগ তো দেইনি, উল্টো তাদের ডিসেম্বর মাসের বেতন আত্মসাৎ করে। তখন অকুল সাগরে পড়েন সেখানে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
রাজ এন্টারপ্রাইজে ক্লিনিং সুপারভাইজার হিসেবে রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত স্বপ্নের আউটলেটে কাজ করতেন মোহাম্মদ আলী। তার অধীনে কাজ করতেন আরও ছয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
মোহাম্মদ আলী জানান, রাজ এন্টারপ্রাইজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তাদের একটি টাকাও বেতন দেয়নি। যে অল্প টাকা বেতন পান, তা দিয়ে কোনো রকমে দিন কাটানোই অনেক কষ্টের। সেই জায়গায় যখন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বেতন দেয় না, তখন পথে বসা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প থাকে না।
স্বপ্নের সাবেক এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, তার অধীনে যারা কাজ করছিল, টাকা দিতে না পারায় তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টায় একটা শিফট, বেলা ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত আরেকটা শিফট। এই দুই শিফটে টানা ১২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পরিষ্কারের কাজ করার পর তাদের টাকা দিতে না পারলে তো আর কথা বলার উপায় থাকে না। তিনি আরও জানান, ১২ ঘণ্টা কাজ করার পর বেতন দিত মাত্র সাড়ে ছয় হাজার টাকা। আর সাপ্তাহিক ছুটি না কাটালে দিত সাড়ে সাত হাজার টাকা। আর তিনি সুপারভাইজার হিসেবে পেতেন সাত হাজার টাকা। সাপ্তাহিক ছুটি না কাটালে সেই অর্থ হতো আট হাজার।
মোহাম্মদ আলী জানান, এত কষ্টে অর্জিত অল্প কিছু টাকা না পেয়ে তাকে দুই ছেলে, স্ত্রী নিয়ে সংসার চালাতে হয়েছে ঋণ করে। পরে চার-পাঁচ মাস লেগেছে ঋণ শোধ করতে। অভাব না থাকলে কেউ পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে আসে না। অথচ তাদের মতো দরিদ্র মানুষদের বেতনের টাকা রাজ এন্টারপ্রাইজ মেরে দিল!
স্বপ্নের এক সময়কার পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, টাকার জন্য তারা রাজ এন্টারপ্রাইজের মালিক ও কর্মচারীদের কাছে তিন থেকে চার মাস দৌড়াদৌড়ি করেছেন। তারা বলে, স্বপ্ন টাকা দেয়নি। স্বপ্নের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তাদের নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখাত রাজ এন্টারপ্রাইজ।
বনানী ১-এর (পুরাতন বনানী) ১২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সুপারভাইজার ছিলেন সবুজ। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দুই মাসের বেতন দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
সবুজ বলেন, ‘আমরা দুই মাস বেতন পাই নাই। এই দুই মাসের বেতনের আশায় আরও দুই মাস বইসা আসিলাম। কিন্তু রাজ এন্টারপ্রাইজ বেতন দিল না।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন