ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের ছয় তলায় ৬০৮ নম্বর রুমের সামনে দাঁড়াতেই চোখ আটকে যায়। কালো অক্ষরে লেখা একটি সাদা কাগজ দরজায় সাঁটানো রয়েছে। আর এতে লেখা মুক্তামনির সুস্থতার জন্য আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। অকারণে প্রবেশ করে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াবেন না।
দরজায় নক করতেই ওপাশ থেকে খুলে দিলেন মুক্তামনির মা আসমা খাতুন। কেবিনের কক্ষে ঢুকে পশ্চিম পাশের বেডে শুয়ে থাকতে দেখা যায় মুক্তামনি। বিরল রোগে আক্রান্ত তার ডান হাতটি একটি তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে ডান হাতের বাহুর দিকে চুলকাচ্ছিলো মেয়েটি। মা মনি কেমন আছো? জানতে চাইলে, সে উত্তরে বলে ভালো আছি। তবে হাতটা নাড়াতে পারছি না। ব্যথাও আছে। এরপর আর কোনো কথা নেই মুক্তামনির মুখে। শুধু দুচোখ ঘুরিয়ে মা-বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি। গ্রামের বাড়ি যাবে প্রশ্ন করতেই মাথা নাড়ে মুক্তামনি। এ সময় মেয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুক্তামনির বাবা-মা।
এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তার বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, মেয়েটা গ্রামের যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে। চিকিৎসকরাও আজ আমাকে ডেকে বলেছেন, আপনারা যেতে পারেন। তবে মেয়ের শরীরের অবস্থায় তিনি অকেটাই শঙ্কিত।
তিনি বলেন, ভাই চেষ্টা কম হয়নি। চিকিৎসকরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছেন। এখন আল্লাহর উপর ভরসা। তবে কবে নাগাদ মেডিক্যাল ছাড়ছেন মুক্তামনি তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে এ সপ্তাহের শেষ দিকে বা আগামী সপ্তাহের প্রথম দিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মুক্তামনির।
মুক্তামনির বাবা বলেন, মুক্তামনির অবস্থা তো জানেন, এই অবস্থায় ওষুধ কেমন কাজ করে বুঝতেই পারছেন। আপনারা আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন ও যেন ভালো হয়ে যায়।
মুক্তামনির বাবা আরো বলেন, অনেক আশায় ছিলাম মেয়ের হাতের ব্যন্ডিস খুলতে চিকন হাতটা দেখতে পাবো। কিন্তু ব্যন্ডিস খোলার পরে আবার হাত ফুলে গেছে। তবে আগের মত গন্ধ আসে না। ব্যাথাও একটু কম। তবে ঢাকা মেডিক্যাল কজেল হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, মুক্তামনির হাতটা ফুলে আছে। হাতে আমরা ব্যান্ডিস দিয়েছি। তাতে হাতের ফুলা কমবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোগটাইতো এরকম সেজন্য ফুলে যায়। তবে আগের চেয়ে অনেক ভালো মুক্তামনি।
সাতক্ষীরার কামারবাইশালের মুদির দোকানদার ইব্রাহিম হোসেনের দুই যমজ মেয়ে হীরামনি ও মুক্তামনি। জন্মের দেড় বছর পর থেকে মুক্তামনির সমস্যা শুরু। প্রথমে হাতে টিউমারের মতো হয়। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত টিউমারটি তেমন বড় হয়নি। কিন্তু পরে তা ফুলে কোলবালিশের মতো হয়ে যায়। মুক্তামনি বিছানায় বন্দী হয়ে পড়ে। হাতে পুঁজ জমে থাকায় তা থেকে সব সময় দুর্গন্ধ বের হতো। হীরামনি ছাড়া অন্য কোনো শিশু এমনকি বড়রাও কাছে ঘেষতেন না। মুক্তামনি এখন পর্যন্ত এক বছর তিন মাস বয়সী ছোট ভাইকে কোলে পর্যন্ত নিতে পারেনি। সাতক্ষীরা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা চিকিৎসা চলে। তবে ভালো হয়নি বা ভালো হবে সে কথা কেউ কখনো বলেননি।
গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে খবর প্রকাশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনায় আসে মুক্তামনির খবর। ১১ জুলাই মুক্তাকে ভর্তি করানো হয় বার্ন ইউনিটে। তারপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তামনির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।
মুক্তামনির জন্য গঠিত আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড জানায়, মুক্তামনি বিরল রোগে আক্রান্ত। রোগটির নাম ‘হাইপারকেরাটোসিস’। পরবর্তীতে মুক্তামনির কাগজপত্র সিঙ্গাপুরে পাঠান বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন। ওই দেশের একটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথাও হয়। তবে সিঙ্গাপুরের ওই হাসপাতাল মুক্তামনির অস্ত্রোপচার করায়নি, ওদের ভাষায়, তা সম্ভব না। ওই চ্যালেঞ্জই নেয় বার্ন ইউনিট।
মুক্তামনির হাতে ১০ অক্টোবর প্রথম অস্ত্রোপচার হয়। তার হাতের ফোলা অংশ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেন চিকিৎসকরা। পরে দুই পায়ের চামড়া নিয়ে দু’দফায় তার হাতে লাগানো হয়। বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ একদল চিকিৎসক মুক্তামনির স্কিন গ্রাফটিং (চামড়া লাগানো) অপারেশনে অংশ নেন। পরে হাত আবার ফুলে যাওয়ায় তা কমাতে হাতে প্রেসার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়া হয়।
চিকিৎসকদের দাবি, এখন অনেকটাই সুস্থ মুক্তামনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আজ মুক্তামনিকে নিয়ে আমাদের একটি বোর্ড মিটিং ছিল। মিটিংয়ে আমরা মোটামুটি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওকে ছেড়ে দেয়ার। তবে কালও চিকিৎসকরা ওকে দেখবে। মুক্তামনির বাবাকে ডেকে বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। মুক্তামনির বাবা-মা নিজেদের সুবিধামত হাসপাতাল ছেড়ে যাবেন।
কবে নাগাত যেতে পারে এমন প্রশ্নে জাবাবে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত বলে দিয়েছি। হয়তো ওর বাবার একটু ঘুচগাছের সময় লাগতে পারে। তবে এ সপ্তাহের শেষে না হয় আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে তারা চলে যাবেন।
তিনি আরো বলেন, মেয়েটিও বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। তাই আমরাও চাই কিছু দিনের জন্য ঘুরে আসুক। মুক্তামনির চেকআপের ব্যাপার আছে, ওষুধপত্র বুঝে নেয়ার ব্যাপার আছে। এখন ছেড়ে দিলেও আমরা পরে তাকে আবার দেখবো। সে আমাদের নিয়মিত চেকআপে থাকবে। এবার ছেড়ে দেয়ার পর আবার কবে আসতে হবে এটা মুক্তামনির বাবা-মাকে বলে দেয়া হবে।
ডা. সামন্ত লাল বলেন, মুক্তামনি ভালো আছে। তবে মুক্তামনির যে সমস্যা, সেটা কখনই শতভাগ সুস্থ হবে না। তবে যাতে ভালো থাকতে পারে আমরা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
দীর্ঘ ছয় মাস মেয়ে মুক্তামনিকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ছিলেন বাবা-মা। সাথে ছিল দেড় বছরের ছোট ভাই আল-আমিন।
মুক্তামনির বাবা বলেন, গ্রামে আমার মা অসুস্থ। আমি নিজেও অসুস্থ। এর মধ্যে মেয়েটার এই অবস্থা। গ্রামে একটি মুদি দোকান চালাতাম। তাও এখন নেই। মুক্তামনির যে দিন বায়োপসি করানো হয়, সেদিনই ঢাকা মেডিক্যালে আমার বাবা মারা যান। এরপর দুই তিন দিনের জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম। টানা এই ছয় মাস মেডিক্যালেই থাকতে হয়েছে। এখন গ্রামে না গিয়ে আর পারছি না। তাই ডাক্তারদের অনুমতিতে গ্রামে যাবো। আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে আমার মেয়ের জন্য দোয়া চাই। যাতে আমার দুঃখী মেয়েটা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন