শহীদ বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যেকে দেশের জন্য কিছু না কিছু করেছেন, কোনো না কোনো কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। তা না হলে তো তাঁদের হত্যা করার প্রশ্ন আসত না। তাঁরা কেন শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবী হবেন? তাঁরা কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী হবেন না?
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে একক বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এ মন্তব্য করেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-২০১৭ উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, যুদ্ধের পর যাঁরা দেশে ছিলেন, তাঁরা কেন মুক্তিযোদ্ধা হবেন না? তাঁরা তো মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি অংশে সমর্থন করেছেন। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দেওয়া হলো, তখন কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল যে বাকি সাত কোটি মানুষ কি রাজাকার? এতে কিন্তু মানুষকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের সময় তিনি যে সমর্থন পেলেন, সেটা একটি ক্ষোভের প্রতিফলন ছিল। সবাইকে যুদ্ধের মধ্যে অন্তর্গত করা যায়নি।
বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির বিষয়ে মুনতাসীর মামুন বলেন, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ কী হবেন? তিনি শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবী থাকবেন? কেন তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী হবেন না? আনোয়ার পাশা—যিনি তখন ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ লিখছিলেন, তিনি কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী হবেন না? আরও যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকে তো কোনো না কোনোভাবে কাজ করেছেন। না হলে তাঁদের হত্যা করার প্রশ্ন আসত না। এ প্রশ্নগুলো এখন উঠছে। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস রচনায় শুধু বিজয়কে দেখলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে।
মুনতাসীর মামুন বলেন, বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও যে নানা মাত্রার ছিল, তা চাপা পড়ে গেছে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায়ও ভারসাম্যহীনতা দেখা গেছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে বলা হয়েছে, যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। সেটা নিয়ে কারও আপত্তিও ছিল না। কিন্তু যখন প্রতি সরকারের আমলে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়, তখন তো বিষয়টি হেয় হয়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা হয়। যদি ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ না দেওয়া হতো, যেটা পৃথিবীর কোথাও দেওয়া হয় না, ওই ধরনের সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে তাঁদের পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনিদের পর্যন্ত সুবিধা বিস্তৃত না করা হতো, তাহলে বোধ হয় বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে হতো না।
মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু দল তৈরি হয়েছিল, যাঁরা দেশে থেকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁদের অঞ্চলকে মুক্তাঞ্চল করেছেন। তাঁদের নাম তো মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেই। তাঁরা তো ইতিহাসে স্বীকৃত হননি। যদি স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের মুক্তিযোদ্ধা বলা যায়, তাহলে যেসব লেখক এখানে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে পত্রিকা বের করেছেন—তাহলে তাঁরা কেন মুক্তিযোদ্ধা হবেন না? তাই এভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা উচিত নয়।
বুদ্ধিজীবীদের শুধু একদিন হত্যা করা হয়নি উল্লেখ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, বুদ্ধিজীবী কতজন মারা গেছেন? যদি বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞার মধ্যে সীমিত থাকা যায়, তাহলে এই সংখ্যাটি কত দাঁড়াবে, সেটাও কিন্তু একটি বিষয়। অনেকে প্রশ্ন করছেন, কেন বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত হয়নি বা বিচার হবে না? জহির রায়হানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছিল, যার পরিণামে জহির রায়হানকেও হত্যা করা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীরা কি শুধু ডিসেম্বরেই নিহত হয়েছেন? তা নয়। ২৫ মার্চ থেকে জহির রায়হানের মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি সময়ই বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাজাকার, আলবদর ও আলশামস—এরা সবাই বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত। এখানে যখন ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি হয়, তখন একটি কথা বলা হয়েছিল, দল হিসেবে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস এদেরও বিচার হওয়া উচিত। আমাদের সেই দাবি এখনো অবহেলিত। বুদ্ধিজীবী হত্যা যেহেতু বৃহত্তর গণহত্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেটার বিচার কিন্তু হচ্ছে। নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লা—এঁদের প্রত্যেকের কিন্তু গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বিচার হয়েছে।’
মুনতাসীর মামুন তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, একমাত্র বাংলাদেশে উঠেছে। আজ আমি মির্জা ফখরুলের বক্তব্য শুনছি। তিনি বুদ্ধিজীবীদের কথা বলছেন এবং বলছেন এখন এত গুম হয়ে যাচ্ছে—খুনি সরকার। কিন্তু ৩০ লাখ মানুষ খুনের বিচার আমরা করতে চেয়েছি, তখন তো খালেদা জিয়া-ফখরুল কোনো কথা বলেননি।’ তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার যে রাজনীতি, সেই রাজনীতি কিন্তু বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশে করে যাচ্ছে। তারা যে মানবতাবিরোধী হত্যায় বিশ্বাস করে, তা তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় বাধা দিয়ে প্রমাণ করেছে।
দেশে বিশ্বাস ও আদর্শের জায়গা শিথিল হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘একটি প্রশ্ন তুলতে পারি যে দেশবিরোধী এসব কাজ করার সুযোগ কারা দিয়েছে? এটা আমরাই দিয়েছি। কীভাবে? মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ১৯৭৫ সালে পাকিস্তানি-বাঙালিদের সমর্থন করেছে। ১৯৮২ সালের পরে এরশাদকে রণ বীর উপাধি দিয়েছে এবং তারা পাকিস্তানি রাজনীতি সমর্থন করেছে। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা তো এটা করতে পারেন না। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, তিনি ভাতা পান কীভাবে? তিনি কীভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন। এই যে স্ববিরোধিতা, সে জন্য আমরা বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াটা যতটা সহজ ছিল, মুক্তিযোদ্ধা থাকাটা ততটা সহজ ছিল না।’
স্মারক বক্তৃতায় সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ মান্নান। বাংলা একাডেমির সচিব মো. আনোয়ার হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন