ইরাকে বৈধতা ছাড়াই কাজ করেন বাংলাদেশি কর্মীরা। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন। জিম্মি হয়ে পড়েন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। জরিমানা গুনতে হয় দেশে ফেরার সময়ও। জনশক্তি বিষয়ে ইরাকের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাজমান সমঝোতা স্মারকের কোনো কার্যকারিতা, জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র (স্মার্ট কার্ড) এবং ঢাকাস্থ ইরাক দূতাবাসের ভিসা স্টিকারের গুরুত্ব না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশি কর্মীরা যে ভিসাতেই ইরাক যান না কেন, তাদের অধিকাংশেরই রেসিডেন্ট পারমিট বা বসবাসের অনুমতি থাকে না।
এদিকে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি না থাকায় দেশটিতে মানবপাচারও বাড়ছে। ইরাক ও বাংলাদেশের মানবপাচারকারী চক্র বিভিন্ন কৌশলে সেদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। মানবপাচার বন্ধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে এ ধারা অব্যাহত রেখেছে তারা। এ ব্যাপারে সঠিক কর্মীরা যেনো সঠিকভাবে দেশটিতে কাজ করতে পারে সে ব্যাপারে সম্প্রতি বাগদাদে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন ২১ দফার একটি ম্যাকানিজম প্রস্তাব দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষকে। বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়েও জানিয়েছে মিশন।
বিএমইটির তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে ইরাকে কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। ওই বছর প্রথমবারের মতো ৪১২ জন কর্মী পাঠানো হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই দেশটিতে কর্মী যাচ্ছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে কর্মী গেছে ৪০ হাজার ৭৪০ জন। তবে বিপুল পরিমাণ এই কর্মীর অধিকাংশেরই প্রবেশের কাগজপত্র থাকলেও তাদের রেসিডেন্সি পারমিট নেই। ফলে তারা সেখানে অবৈধভাবে বসবাস করে কাজ করছে।
সূত্র জানিয়েছে, ইরাকে জনশক্তি নিয়োগে দেশটির শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব খুবই নগণ্য। কারণ জনশক্তি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ততা গৌণ। দেশটিতে সাধারণ পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ ও ভিসা ইস্যু, আগমন, অবস্থান এবং দেশত্যাগের পুরো বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে। ইরাকি ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট কমিশন (এনআইসি) এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদা মোতাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিসা ইস্যু করে থাকে। শ্রমিক বা পর্যটক যাওয়ার ক্ষেত্রে ইরাক ইমিগ্রেশনের কাছে বৈধ পাসপোর্ট এবং অনুমোদিত পেপার ভিসাই মূল বিবেচ্য। ফলে জনশক্তি বিষয়ে ইরাকের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব সমঝোতা হয়েছে বাস্তবে তার কার্যকারিতা নেই। বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র বা ঢাকাস্থ ইরাকি দূতাবাসের ভিসা স্টিকারও কোনো গুরুত্বই বহন করে না। যে ভিসাতেই প্রবেশ করুক, অধিকাংশ বাংলাদেশি নাগরিকেরই রেসিডেন্ট পারমিট (পিআর) থাকে না।
তবে সেদেশে তারা অবৈধভাবে বসবাস করলেও, কাজ করতে তাদের কোনো বাধা নেই। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দেয়া ইরাকে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত আবু মাকসুদ মো. ফরহাদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ইরাকের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জানা গেছে, তাদের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রেসিডেন্সি পলিসি কঠিন রাখা হয়েছে। বাংলাদেশি কর্মীদের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে ইরাকি রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষ বৈধ পাসপোর্ট এবং লিগ্যাল এন্ট্রি বিবেচনা করে থাকে। এছাড়া অবৈধভাবে বসবাস একদিন বা ৫-১০ বছর যাই হোক তার জন্য ৪০০ মার্কিন ডলার জরিমানা দিতে হয়। এ তিনটি শর্ত পূরণ করলেই বাংলাদেশি কর্মীরা বহির্গমন ভিসা পান। যাদের রেসিডেন্সি পারমিট (পিআর) থাকে তাদের ক্ষেত্রে বহির্গমন ভিসার দরকার হয় না। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশি কর্মীরা কেউ-ই রেসিডেন্সি পান না, তাই দেশে ফিরতে তাদের সকলকেই জরিমানা গুনতে হয়। অন্যদিকে যেসব বাংলাদেশি কর্মীর ভুয়া পাসপোর্ট, ভুয়া ভিসা, নো ভিসা ইত্যাদি থাকে, নিয়মমাফিক তাদের সাজা ভোগ করেই দেশে ফেরত আসতে হয়। এসব দিক বিবেচনা করে দেশটির কর্তৃপক্ষকে ১৯ দফা দাবি সংবলিত একটি ম্যাকানিজম প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশি মিশন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইরাকি নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদাপত্রে শ্রম ও সমাজ কল্যাণ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেবে। চাহিদাপত্রে শ্রমিকের ট্রেড ও বেতন-ভাতাদি উল্লেখ থাকবে। নিয়োগকারী ব্যক্তি বা কোম্পানির দাখিলকৃত চাহিদাপত্রের যথার্থতা যাচাইপূর্বক দূতাবাস সত্যায়ন করবে। রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিয়োগানুমতি নিয়ে ট্রেডভিত্তিক কর্মী নির্বাচন ও নির্বাচিতদের পাসপোর্টের কপি নিয়োগকর্তার কাছে পাঠাবে। নিয়োগকারী কোম্পানি ইরাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২ বছরের ওয়ার্ক ভিসা গ্রহণ করে রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রেরণ করবে। ইরাকি ইমিগ্রেশন আগত কর্মীদের ভিসা, পাসপোর্ট এবং স্মার্ট কার্ড-এর যথার্থতা যাচাই করে এন্ট্রি দেবে। বিষয়টি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং রেসিডেন্সি ডিপার্টমেন্টকে রিপোর্ট করবে। কর্মীদের রেসিডেন্সি পারমিট বা আকামা থাকা না থাকার বিষয়ে নিয়োগকারীই সম্পূর্ণভাবে দায়ী থাকবেন। কোনো অবস্থাতেই নিয়োগকারী কর্মীদের অন্য কর্মীদের নিয়োগকারীর নিকট হস্তান্তর বা বিক্রি করতে পারবে না। নিয়োগকারী কোম্পানি যাবতীয় বকেয়া পাওনা ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণসহ কর্মীদের মৃতদেহ দেশে পাঠাবে।
বাগদাদ দূতাবাসের ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, ইরাক ও বাংলাদেশের মানবপাচারকারী চক্র ইরাকে ভিজিট ভিসা, ইরাকের ফ্লাইট বোর্ডিংপূর্বক ইরান ভিজিট ভিসায় বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে ইরান হয়ে স্থলপথে ইরাক পাচার করে। এছাড়া ভুয়া পাসপোর্ট, ভুয়া ভিসা ও নো ভিসায়ও ইরাকে কর্মী যাচ্ছে। এসব কর্মীদের নিয়মিতকরণ কখনোই সম্ভব নয়। গ্রেপ্তার হলে ইরাকের আইনানুযায়ী তাদের সাজা ভোগ করতে হবে। সাধারণ ক্ষমার সুযোগও তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মিশনের নিরলস প্রচেষ্টায় ইরাক সরকার প্রতিবছর ১-২ বার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা করে। যেসব কর্মী বৈধভাবে ওয়ার্ক ভিসায় ইরাক প্রবেশ করেন, সেসব কর্মী তাদের বর্তমান, প্রকৃত বা নতুন কফিল বা নিয়োগকারীর মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে এবং আকামা সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু ভিজিট ভিসা, নো ভিসা, ভুয়া ভিসা, ভুয়া পাসপোর্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমার সুযোগ কাজে আসে না। এ অবস্থায় মিশন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চারটি অনুরোধ জানিয়েছে। এগুলো হলো, মিশনের প্রস্তাবিত ২১ দফা পরিমার্জন করে বাংলাদেশস্থ ইরাক দূতাবাসে প্রেরণ, বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে কর্মীদের গন্তব্য দেশের ভিসা, বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র এবং ফ্লাইট বোর্ডিং-এর যথার্থতা নিশ্চিতকরণ, ইরাক ভিজিটের ক্ষেত্রে ভিজিটর বা পর্যটকদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র এবং ফ্লাইট বোর্ডিং-এর যথার্থতা নিশ্চিতকরণ। সর্বশেষ উভয় দেশের মধ্যে বিরাজমান সমঝোতা স্মারক কার্যকর করার উদ্যোগ বা নবায়ন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন