নানা নাটকীয়তা এবং সরকারের আনা দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াগামী ফ্লাইট ধরার মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যেই ইতিহাস হয়ে গেছেন। যেভাবেই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, বেশ নাটকীয় সময় ছিল তার। এর শুরু হয়েছিল বিচার বিভাগের শ্রেষ্ঠত্ব সমুন্নত করা এবং নির্বাহী বিভাগকে প্রতিরোধ করার মধ্য দিয়ে। এর ফলে রাষ্ট্রের দুটি বিভাগের মধ্যে যে সঙ্ঘাত দেখা দেয়, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। অবশ্য বিচারপতিদের অভিশংসন করার ক্ষমতা সংসদকে দিয়ে করা ষোড়শ সংশোধনীটি বিচারপতি সিনহার সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বাতিল করে দেওয়ার পর সঙ্ঘাতটি লড়াইয়ে পরিণত হয়।
রায় নিয়ে ক্ষোভ এবং আবেদন
রায়ের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার রাজপথে বিক্ষোভসহ ব্যাপক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালায়। এতে করে বৈরিতার সূচনা হয়। সব বিচারপতিই রায়ে সই করলেও এটাকে বিচারপতি সিনহার কাজ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাকে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়। তাকে পদত্যাগ, বরখাস্ত, বহিষ্কার এবং নির্বাসন দেওয়ার দাবি করা হয় প্রকাশ্যে। রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো যখন প্রকাশ করা হয়, তখন যেন আসমান ভেঙে পড়ল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাতে জাতির পিতা শেখ মুজিবের সমালোচনাকে তার প্রতি চূড়ান্ত অপমান হিসেবে বিবেচনা করে। এই পর্যায়ে সঙ্ঘাতটি শেখ মুজিবের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়। সঙ্ঘাতটি মীমাংসার বাইরে চলে যায়।
এরপর রায়কে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করার সংসদের সিদ্ধান্ত এবং তীব্র বাদানুবাদের পর সিনহার তুলনামূলক নীরবতা অবলম্বনে মনে হচ্ছিল, পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে। কিন্তু পরের ঘটনাবলীতে প্রমাণিত হয়, সম্পর্কটি ভেঙে গেছে। পরে আঞ্চলিক একটি মিডিয়ায় জল্পনা প্রকাশ পায়, জাপান সফরকালে বিচারপতি সিনহা বলেছেন, তিনি ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করবেন। সুবীর ভৌমিকের লুক ইস্ট পোর্টালে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করে ১৫৩ জন সুপরিচিত আইনজীবী রিট দাখিল করবেন এবং এর রেশ ধরে বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর একটি গ্রুপ ক্ষমতা গ্রহণ করবে।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে বিচারপতি সিনহা ফিরে আসার সাথে সাথে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, তিনি গৃহবন্দি। অসুস্থতার কারণে ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে করা সিনহার লেখা একটি চিঠি প্রকাশ করেন আইনমন্ত্রী। এতে দাবি করা হয়, তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে বিরোধী বিএনপি দাবি করে বসে, সিনহারকে জোরপূর্বক চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
সবশেষে তিনি বিমানবন্দরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তার সরকারি বাসভবনের বাইরে মিডিয়ার সাথে আলাপ করেন এবং নাটকীয়ভাবে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তিনি ‘বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে’ চলে যাচেছন, প্রধানমন্ত্রী ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি মোটেই অসুস্থ নন।
তিনি চলে যাওয়ার পর- অনেকের মতে চলে যেতে তিনি বাধ্য হয়েছেন- সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারারের অফিস মিডিয়ার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতির কাছে প্রধান বিচারপতির দুর্নীতি-সংক্রান্ত নথিপত্র হস্তান্তর করলে এবং তিনি বেঞ্চ সদস্যদের কাছে এ ব্যাপারে যথাযথ জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তারা তার সাথে একই বেঞ্চে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অনুপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত এবং রেজিস্ট্রারারের এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ করা নজিরবিহীন বিষয়। এরপর রেজিস্ট্রারারসহ সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তাদের বদলির ঘটনা ঘটে।
একটি রাজনৈতিক থ্রিলারের সব উপাদানই এই ঘটনায় রয়েছে। তবে বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে থ্রিলারটি অব্যাহত রয়েছে। আর ষোড়শ সংশোধনীটি নিয়ে বিতর্কিত রায়টি শিগগিরই রিভিউ’র আওতায় থাকায় সব নাটকীয়তা এখন সেদিকেই কেন্দ্রীভূত হবে।
সিনহা থেকে মিঞা
তবে এটা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের জন্য খুবই কঠিন অধ্যায়। কারণ সরকারের দাখিল করা রিভিউ পিটিশন ইতোমধ্যেই তার ও বেঞ্চের হাতে পৌঁছেছে। যে রায়টি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, তাতে সব সদস্যই একই পক্ষভুক্ত। রায়টি বহাল রাখা হলে সরকারের জন্য রাজনৈতিক মূল্য হবে অনেক বেশি। এতে প্রমাণিত হবে, রাজনৈতিক বিক্ষোভগুলো ঠিক ছিল না। অর্থাৎ রায় যদি না বদলানো হয়, তবে সরকার তার রাজনৈতিক মূল্য হারাবে, ২০১৮ সালের নির্ধারিত নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর বিএনপি নৈতিক জয় দাবি করবে, এটা তারা নির্বাচনে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে।
অন্যদিকে রিভিউ পিটিশনের ফলে রায়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হলে সুপ্রিম কোর্ট বিবেচিত হবে ‘দুর্বল ও আপসকামী’। কারণ বেঞ্চের আগের দেওয়া রায় ও পর্যবেক্ষণের ফলে ব্যাপক ‘গোলযোগ’ দেখা দিয়েছিল, পুরো সরকারি ব্যবস্থারই সমালোচনা করা হয়েছিল।
বিচারপতি সিনহার সময়ে দেওয়া রায় থেকে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে এই সংশয়ের সৃষ্টি হবে, বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের রাজনৈতিক চাপ সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নেই। এটা ক্ষমতায় থাকা উভয় পক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতায় ক্ষতির সৃষ্টি করবে। আর বিএনপি দাবি করবে, আওয়ামী লীগ সরকার একজন শক্তিশালী প্রধান বিচারপতিকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে ভারপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দায়িত্ব দিয়েছে। এরও রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে।
অর্থাৎ সরকার বা সুপ্রিম কোর্ট এবং সেই সুবাদে বিচার বিভাগ কারো জন্যই মোটেই ‘উইন-উইন’ অবস্থা নেই। আগামী কয়েক মাসে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তাতেই বোঝা যাবে শাসনব্যবস্থা পরিপক্কতা লাভ করেছে কী করেনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন