দেশজুড়ে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। অসহ্য গরমে অসুস্থ হয়ে প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মানুষ। ১৯ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে অন্তত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিনেই সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও প্রচণ্ড গরমে স্কুল-কলেজ, মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই। চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হয়ে রবিবার পর্যন্ত দেশে তাপপ্রবাহ চলছে, যা আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে দেশে টানা এতদিন তাপপ্রবাহ হয়নি। এর মধ্যেই সাধারণ তাপপ্রবাহ অতি তীব্র তাপপ্রবাহে রূপ নেয়, যা চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পারদ ছোঁয়। এ অবস্থায় গত ১৯ এপ্রিল থেকে দেশে পর্যায়ক্রমে হিট অ্যালার্ট জারি করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়বে। শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এছাড়া যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি।
এদিকে হিট অ্যালার্টের মধ্যেই রবিবার খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুল খোলার দিনই স্কুলে গিয়ে গরমে অসুস্থ হয়ে দুই শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। নোয়াখালী ও ফরিদপুরে দুই ডজনের বেশি শিক্ষার্থী অসু্স্থ হয়ে পড়েছে। এতে আতঙ্কিত অভিভাবকরা। তারা বলছেন, হিট অ্যালার্ট চলছে, এরমধ্যে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেক অভিভাবকই সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাচ্ছেন না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মো. গোলাম মাওলা নামের একজন পোস্ট করে বলেন, ‘এই গরমে আমি আমার সন্তানকে স্কুলে পাঠাব না। আপনি পাঠাবেন?’
হুমায়ুন কবির খান নামে একজন লিখেছেন, ‘অসহ্য গরমে আমি আমার ছেলেকে বিদ্যালয়ে পাঠাব না। কারণ তারা বাসায় যে পরিমাণ অসহ্য বোধ করে স্কুলে কী না জানি করবে?’
গরমে দুই জেলায় অসুস্থ ২৭ শিক্ষার্থী
তীব্র গরমে দুই জেলায় তিন শিক্ষকসহ অন্তত ২৭ শিক্ষার্থীর অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রবিবার সকালে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও হাতিয়া জনকল্যাণ শিক্ষা ট্রাস্ট হাই স্কুলের ১৪ জন শিক্ষার্থী এবং একজন শিক্ষক।
জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১০টা দিকে বেগমগঞ্জ উপজেলার আমান উল্যাপুর ইউনিয়নের জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা চতুর্থ শ্রেণির একজন ছাত্রী প্রথমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে একই শ্রেণির আরও তিন ছাত্রী প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমান জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে চার ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের চিকিৎসা দিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপর শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি পানি খাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
হাতিয়া জনকল্যাণ শিক্ষা ট্রাস্ট হাই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ১১ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইমরান হোসেন। পরে তাদের সবাইকে বিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী মা-মনি ক্লিনিকের একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ফরিদপুরের সালথায় তীব্র দাবদাহের মধ্যে টিউবওয়েলের পানি খেয়ে একটি স্কুলের তিন শিক্ষক ও ১০ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থদের মধ্যে এক শিশুসহ তিন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রবিবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সালথা থানার ওসি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, পানি খেয়ে নয়-গরমে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
হিট স্ট্রোকে রবিবার ঢাকাসহ ছয় জেলায় আটজনের মৃত্যু
রবিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে হিট স্ট্রোকে আটজনের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রবিবার সকাল ৯টার দিকে যশোর সদরের আমদাবাদ হাইস্কুলের শিক্ষক আহসান হাবিব গরমে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। তিনি উপজেলার আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এজেডএম পারভেজ মাসুদ জানান, শিক্ষক আহসান হাবিব সকালে মাঠে কাজ করে নয়টার দিকে বিদ্যালয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রাজধানীর বংশাল থানাধীন গুলিস্তান ফুলবাড়ীয়ায় প্রচন্ডে গরমে বজলুর রহমান (৫০) নামের ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক কমিউনিটি পুলিশের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নিয়ে আসা সহকর্মী কমিউনিটি পুলিশ রুহুল আমিন বলেন, বিকালে তিনি ডিউটি পালনকালে প্রচণ্ড গরমে হঠাৎ মাথা ঘুরে অচেতন হয়ে পড়েন। পরে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে অচেতন হয়ে পড়েন মাদ্রাসাশিক্ষক মাওলানা মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী (৫৫)। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক কুতুবী আলকাদেরী কক্সবাজারের কুতুবদিয়া লেমশীখালীর মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে। তার দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টার দিকে কালুরঘাটে ফেরিতে ওঠার পর হঠাৎ পড়ে যান ওই মাদ্রাসা শিক্ষক।
নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সুলতান উদ্দিন (৭৮) নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। রবিবার দুপুরে নরসিংদী আদালত প্রাঙ্গনে এই ঘটনা ঘটে।
মাদারীপুরে পৃথক স্থানে খুচরা ব্যবসায়ী ও এক কৃষক হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। তারা হলেন কালকিনির পশ্চিম শিকারমঙ্গল গ্রামের মৃত সালাম সরদারের ছেলে ব্যবসায়ী শাহাদাৎ সরদার (৫২) এবং ডাসার উপজেলার মৃত ইসলাম ঘরামীর ছেলে কৃষক মোসলেম ঘরামী (৫৮)। তাদের মধ্যে শাহাদাৎ রবিবার সকালে ও মোসলেম দুপুরে মারা যান।
স্বজন ও স্থানীয়রা জানায়, সকালে ব্যবসায়ী শাহাদাৎ সরদার প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে বাড়ির বাইরে বের করা হলে কিছুক্ষণ পর বুকে ব্যথা হলে তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে বাড়ির পাশে পাটের জমিতে কাজে যান কৃষক মোসলেম। কাজের ফাঁকে প্রচণ্ড রোদে ‘হিট স্ট্রোকে’ তার মৃত্যু হয়।
রাজশাহীতে হিট স্ট্রোকে দিলীপ বিশ্বাস (৩৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি জেলার পবা উপজেলার দামকুড়া থানার কাদিপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছেন, দিলীপ বিশ্বাস একদম সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন। আজ সকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাই তাঁরা ধারণা করছেন, বৈশাখের এই প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়াও তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় এক সিএনজি অটোরিকশার যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম সেলিম মিয়া (৫৫)। রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত সেলিম পেশায় মাংস ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানা গেছে।
এরআগে সারাদেশে গত দুই দিনে (শুক্র-শনিবার) হিট স্ট্রোকে আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। এমন বাড়তে থাকলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বাড়বে। হিট স্ট্রোকে শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। কারণ শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যান্সারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যেকোনো কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
এই চিকিৎসক বলেন, যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক। শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্নতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকে ব্যক্তি নিজেই দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন। প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না। কিন্তু যদি হিট স্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সব সময় খেয়াল রাখবেন হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। হিট স্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন। গরমের এই সময়টায় সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গেলে বেশির ভাগ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। সবাইকে মনে রাখতে হবে এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন