মাঠের খেলাকে কেন্দ্র করে স্কুল ছাত্র রাজিবকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয় স্থানীয় বখাটে কিশোর মাহিদ। ছোট ভাইকে হুমকির বিষয়টি জানতে পেরে বিষয়টি মিটমাট করিয়ে দিতে মাহিদের সঙ্গে দেখা করে রাজিবের কলেজ পড়ুয়া ভাই রাব্বি। এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মাহিদ। সে ডেকে আনে তার কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্যকে। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে মাহিদের সহযোগী আশরাফুল রাব্বির মাথায় রড দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাব্বি। রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে আনার পথেই মারা যান মেধাবি শিক্ষার্থী রাব্বি। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভোলার দৌলতখান পৌরসভার সোনালী ব্যাংক-সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত রাব্বির পিতা জামাল উদ্দিন খুবই দরিদ্র। খেয়াঘাটের একজন মাঝি। আবার মাঝে মধ্যে মাছ শিকার করে সংসার চালান। অনেক অভাব-অনটনের মধ্যেই তার দুই ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। নিহত রাব্বি বাংলাবাজার ফাতেমা খানম মহাবিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিল। ছোট ছেলে রাজিব দশম শ্রেণীর ছাত্র।
শুধু এক রাব্বিই নয়। এভাবে অনেক মেধাবী নিহত হয়েছেন ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। কিশোর গ্যাং এখন রাজধানীসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত। সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিস্কো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে কিশোর আদনান খুনের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও তৎপরতার কারণে গ্যাং কালচার স্তিমিত ছিল। এটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বর্তমানে কিশোর গ্যাং কালচার নিছকই এক সমস্যা নয়, এটা এখন মহাসংকটে পরিণত হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত দুই শতাধিক কিশোর খুন হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতা অথবা স্থানীয় প্রভাবশালী তাদের স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহারের জন্য গ্যাং তৈরি করে। এছাড়া আমাদের দেশে শিশুদের লালনপালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য পারিপার্শিকতার কারণেও কিশোররা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আবার শিশুকিশোরদের মধ্যে বর্তমানে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব থাকায়ও তারা সহজে বিপথগামী হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একটা সময় ছিল ছোট বেলায় শিশুদেরকে পাড়ার মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো। এতে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষায় শিশুদের মানসিকতা গড়ে ওঠত। আর তাতে শিশুরা কিশোর বা তরুণ বয়সেও নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে তাদের জীবন পরিচালনা করতো। বর্তমানে সমাজে এ ধরনে শিক্ষা অনেকটাই কমে গেছে। এতে কিশোররা সহজেই বিপথগামী হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের সংকোচন, অপরাধনির্ভর দেশি-বিদেশি সিনেমা, হিরোইজম এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাকেই এই কিশোর গ্যাং নামক সামাজিক দুর্যোগের অন্যতম কারণ। এছাড়া বর্তমানে কাজ না থাকায়, আয় উপার্জনহীন কিশোররা সহজেই অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছে। শিশু-কিশোরদের পথভ্রষ্ট হওয়ার বড় একটি কারণ হলো-ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়। একসময় প্রতিটি এলাকায় মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জিনদের একটি বিশেষ অবস্থান ছিল। তাদের ছোট-বড় সবাই মানত। শিশু-কিশোররা তাদের কথা অবশ্য পালনীয় মনে করত। তারাও এলাকার কিশোর-তরুণদের স্নেহ-আদর এবং শাসন করতেন। সমাজে সেই ধর্মীয় সংস্কৃতির অবনতি ঘটেছে।
গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া এসব কিশোর অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব ইনকিলাবকে বলেন, হঠাৎ করেই কিশোর অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমি মনে করি না। এটা সময় নিয়েই হয়েছে। একের পর এক ঘটনার পর এখন গুরুত্ব সবার নজরে এসেছে। তাদের কিছু কিছু অপরাধের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এরা পেশাদারি অপরাধীদের ছাড়িয়ে গেছে। পারিবারিক বন্ধন অনেক ক্ষেত্রেই ঢিলে হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি সুস্থ বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার অভাব, বয়সের অপরিপক্কতা, অর্থলোভ, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিরোইজম কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারেরও ভয়াবহ কুফল এই চিত্র।
কিশোর অপরাধী সৃষ্টি হবার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে সামজিক ও পরিবারিক বন্ধন ছিলো। পাড়া মহল্লা থেকে শুরু করে সবাই ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেছে। এখন সেগুলোর অনুপস্থিতি রয়েছে। তিনি বলেন, শিশুরা অপরাধে না জড়ায় এজন্য পরিবারিকভাবেই ৪টি উপাদান ছিলো। যেমন এ্যাটার্চমেন্ট, ইনভলমেন্ট, কমিটমেন্ট ও বিশ্বাস। অর্থাৎ পরিবার বা সমাজের মুরব্বীদের সাথে শিশু কিশোরদের সব সময় যোগাযোগ, খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা, শিশুরা কোথায় যায় কি করে সেটির জবাবদিহিতা অর্থাৎ কমিটমেন্ট এবং সর্বশেষ বিলিভ অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাস। পাপ অথবা অপরাধ করলে ধর্মীয় শাস্তি। এখন এসব উপাদানের সঙ্গে শিশুদের সম্পৃক্তা নেই। নেই পারিবারিক বন্ধন, নেই জবাবদিহিতা নেই ধর্মীয় বিশ্বাস।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব শায়খুল হাদীস মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আগেরকার দিনে আমরা সকাল বেলা মসজিদের মক্তবে পড়তে যেতাম। শহর ও গ্রামের প্রতিটি মসজিদেই পবিত্র কুরআন শিক্ষার এক ভিন্ন রকম আমেজ ও আবহ বিরাজ করতো এবং এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে পারিবারিক ও সামজিক বন্ধনটাও অনেক শক্তিশালী থাকতো। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনায় গড়ে ওঠত শিশুদের মন মনসিকতা। কিন্তু কালের আবর্তন-বিবর্তনে আজ ঐতিহ্যবাহী প্রভাতকালীন মক্তব শিক্ষার সেই পুরনো রূপ হারিয়ে গেছে। দেশের অধিকাংশ স্থানে এই শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, কোথাও ঢিলেঢালা ভাবে চলছে। এর অবধারিত পরিণতি হিসেবে সমাজে আজ নানাবিধ অবক্ষয় ও বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিশু শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ভাবে বিপথগামী হচ্ছে, তৈরী হচ্ছে কিশোরগ্যাং। তিনি বলেন, সাধক রূমী (রহ.) বলেছেন, রাজমিস্ত্রী যদি কোন ভবনের প্রথম ইটটি বাঁকা করে বসায় তাহলে যত উঁচুই হোক না কেন ভবনটি কিন্তু বাঁকাই হবে। ঠিক তদরূপ পবিত্র কুরআনের শিক্ষা দ্বারা যদি মুসলিম শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু না করা হয় তাহলে পরবর্তী জীবনে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিনই হবে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আইন অনুযায়ী কিশোররা অপরাধ করলে তাদের পেশাদারী অপরাধীদের মতো কারাগারে না রেখে সংশোধনাগারে রাখা হয়। তবে জেলখানার মতো কিশোর সংশোধনাগারেও অধিক অপরাধী রয়েছে। যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ নিবাসী রাখার সঙ্গে দীর্ঘদিনের জনবল সঙ্কটে প্রকট আকার ধারণ করছে কেন্দ্রটিতে। জনবল সঙ্কটে খালি থাকা বিভাগ ও পদগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। একই সাথে পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও পরিমিত খাবার গুরুত্বপূর্ণ হলেও কেন্দ্রে তা পাচ্ছেন না। একজন উঠতিবয়স্ক প্রয়োজনের চেয়েও কম খাবার পাচ্ছেন। তথ্য অনুযায়ী যশোরে আসনসংখ্যা ১৫০, তবে বর্তমানে সেখানে আছে ২৮৪ জন। অর্থাৎ আসনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি নিবাসী নিয়ে কেন্দ্রটি চলছে। কয়েক মাস পর পর তিন বা সাড়ে তিনগুণও হয়ে যায় নিবাসীদের সংখ্যা। বর্তমানে অবস্থান করা নিবাসীদের মধ্যে ৬৭ জন হত্যা মামলা, ৭০ জন নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, ৬৫ জন মাদক মামলা, ৪ জন অস্ত্র মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্তরা আছে। নিবাসীদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সীর বেশি ১২ জন। এখানে থাকার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ১৮ বয়স নিবাসীরা এখানে থাকার বিধান না থাকলেও জন্মনিবন্ধন জটিলতায় আদালতের নির্দেশে তারা রয়েছেন। কেন্দ্রটিতে অনুমোদিত পদ ৪৯, এর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন পদে কর্মরত ২৪ জন। সম্প্রতি কেন্দ্রটি থেকে বের হওয়া কয়েকজন কিশোরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবনমান, খাবারদাবার অত্যন্ত নিম্নমানের। পর্যপ্ত ঘুমানোর জায়গা, বরাদ্দের অভাবে পেটপুরে খাওয়া শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো সুযোগও পাচ্ছে না শিশুরা। এসব কারণে সংশোধনের পরিবর্তে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হিংস্র হয়ে উঠেছে। সমাজ সেবা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান তিনটি কিশোর সংশোধনাগারের সাথে আরও ৯টি খুব শিগগিরই চালু হচ্ছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কিশোর অপরাধ দমন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযান চালিয়েও কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সারা দেশে মোট কতগুলো কিশোর গ্যাং রয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই কোনো সংস্থার কাছে। তবে বিভিন্ন সময়ের মামলা ও ডাটাবেজ দেখে পুলিশ সূত্র বলছে, ঢাকাসহ সারাদেশে সারাদেশে কিশোর অপরাধীদের দু’শতাধিক সক্রিয় দল রয়েছে। এসব দলে অন্তত হাজার ৪০ জন কিশোর রয়েছে। সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্ট বক্তারা বলেন, কিশোর গ্যাং এখন এতটাই বিপদজনক যা সমাজের স্থিতিশিলতা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বড় একটি ঝুঁকি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারুন উর রশীদ বলেন, শিশু-কিশোররা তো অপরাধ করে না, তারা ভুল করে। তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে হবে। তাদের সামনে ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আর কিশোর গ্যাং নিজে নিজে তৈরি হয় না। এদের পেছনে থাকে ‘সিনিয়র গ্যাং’।
বাংলাদেশ পুলিশ স্টাফ কলেজের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, শিশুদের ছোটবেলা থেকেই পরিবার এক ধরনের মাইন্ডসেট ঠিক করে দেয়। এটি করা যাবে, ওটি করা যাবে না। এ বিষয়গুলো শিশুর বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ সমস্যা সমাধানে কাউন্সেলিং গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের শাসন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন