দরিদ্র পরিবারের কন্যাশিশু প্রীতি ওরাং। নিত্য অভাবে জর্জরিত চা শ্রমিক মা-বাবার সংসার। নিরাপদ জীবনের আশায় মাত্র ১৩ বছর বয়সেই গৃহকর্মী হিসেবে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। দুই বছর ধরে সে কাজ করছিল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায়।
কিন্তু নিরাপদ জীবন নিয়ে আর মায়ের বুকে ফেরা হলো না প্রীতির। ফিরেছে তার নিথর দেহ। মেয়ের মৃত্যুশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা। কিছুতেই থামছে না তাঁর আর্তনাদ।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আশফাকের অষ্টম তলার ফ্ল্যাট থেকে নিচে পড়ে প্রাণ হারায় প্রীতি। গত বুধবার রাতে ঢাকা থেকে প্রীতির মরদেহ কমলগঞ্জ উপজেলার মিতিঙ্গা চা-বাগানে এলে নেমে আসে শোকের আবহ। এ ঘটনায় গোটা চা-বাগানের মানুষ শোকে হতবিহ্বল। প্রীতির এমন মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না।
প্রীতির শেষকৃত্য হয়েছে তিন দিন পেরিয়ে গেছে। অথচ পুরো চা-বাগান এলাকায় এখনো শোকের পরিবেশ। রবিবার সরেজমিনে মিতিঙ্গা চা-বাগানের ফাঁড়ি বাগান হালকি টিলায় গেলে দেখা যায়, নিহত প্রীতির বাবা লুকেশ ওরাং, মা নওমিতা ওরাং, বোন স্বপ্না ওরাং ও ভাই সঞ্জয় ওরাং উঠানে বসে বিলাপ করছেন।
প্রীতির বাবা চা শ্রমিক লুকেশ ওরাং কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মৌলভীবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক মিন্টুর ওপর আস্থা রেখে মেয়েকে ঢাকায় দিয়েছিলাম। তখন তারা বলেছিল, সেখানে আমার মেয়ে ভালো খাবে, সুখে থাকবে এবং বাসায় বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করবে।
মাসে মাসে টাকাও দেবে। কিন্তু আমার মেয়েটি লাশ হয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়ি ফিরল। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, দিন আনি, দিন খাই। মিন্টু আমাকে অনেক ধরনের প্রলোভন দেখিয়েছিল। মেয়ের নিরাপদ জীবনের কথা বলেছিল। আমি এক পর্যায়ে তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম। মেয়ে পাঠানোর প্রথম দিকে ১০ হাজার টাকা দেয়, পরে আরো পাঁচ হাজার টাকা দেয় মিন্টু। এরপর আর কোনো টাকা-পয়সা দেয়নি। কোনো দিন ওই বাসায়ও নিয়ে যায়নি।’
লুকেশ বলেন, ‘দুই বছর হলো আমার মেয়েকে একটিবারও দেখতে দেয়নি ওরা। মেয়েকে একটি দিনের জন্যও ছুটি দেয়নি। নানা অজুহাত দেখাইত। মাসে দুই-একবার গৃহকর্তার মোবাইলে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দিত।’
এ সময় প্রীতির মা নওমিতা ওরাং বলেন, ‘আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে যেসব খরচপাতি লাগবে, সব টাকা দিবে বলেছিল ওই সাংবাদিক। মিন্টু সাংবাদিক বলল তোমার মেয়েকে দেও ওই বাসায়, সাংবাদিকের একটি বাচ্চার সঙ্গে খেলাধুলা করবে, ভালো খাইবে। এখন আমার মেয়েকে নিয়ে মেরে ফেলবে, এই কথা তো আমার জানা ছিল না। ওকে নিরাপদ জীবনের আশায় পাঠিয়ে ফেরত পেলাম লাশ।’
প্রীতির চাচা লগেন ওরাং বলেন, ‘মেয়েকে নিশ্চয়ই নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে।’ নিহত প্রীতির সহপাঠী প্রতিবেশী কিশোরী কবিতা ওরাং বলে, ‘আমি প্রীতি হত্যার বিচার চাই।’ একই কথা প্রীতির সহোদর বোন স্বপ্না ওরাংয়ের।
মিতিঙ্গা চা-বাগানের হালকি টিলার পূর্ব লাইনের বাসিন্দা অমৃত ওরাং বলেন, ‘প্রীতির সঙ্গে এমন কোনো কাজ করছে, যা ঘরের কেউ হয়তো দেখেছে। তাই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলা হাইতে পারে বলে আমার ধারণা।’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মনু-দলই ভ্যালির সভাপতি ধনা বাউরি বলেন, প্রীতি ওরাংয়ের মৃত্যু আসলেই দুঃখজনক। প্রীতি যে ঢাকায় ওই সাংবাদিকের বাসায় কাজ করতে গেছে, সেটা বাগানের কেউই জানে না। প্রীতির মা ও বাবার সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক মিন্টু দেশোয়ারা গোপনে তাকে ঢাকায় পাঠায়। আমি প্রীতি হত্যায় জড়িতদের তদন্তসাপেক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমদ বদরুল বলেন, তদন্তে প্রীতি হত্যার প্রকৃত ঘটনা সঠিকভাবে উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন