স্থপতি ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূঁইয়ার তেজগাঁওয়ের বাসায় এখনও শোকের মাতম। বেদনার ছাপ পরিবারের সবার চোখে-মুখে। পুরো বাড়িটিই থমথমে। তিন সন্তান এখনও ভাবছে, তাদের বাবা বাসায় ফিরে বিকালে বাসার ছাদে নিয়ে যাবেন। তারা ইমতিয়াজের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকে কারও সামনেও যাচ্ছে না।
গত ৮ মার্চ সন্ধ্যায় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের মরিচা সেতু এলাকা থেকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে স্থপতি ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূঁইয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার আগের দিন ৭ মার্চ দুপুরের পরে কাজের কথা বলে বের হয়ে নিখোঁজ হন ইমতিয়াজ। লাশ উদ্ধার হওয়ার দিন ৮ মার্চ দুপুরের পর ডিএমপির কলাবাগান থানায় একটি নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার স্ত্রী। ৯ মার্চ আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে সিরাজদিখান থানা পুলিশ। সে দিনই বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ইমতিয়াজের মৃত্যু নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইমতিয়াজ সমকামীদের সঙ্গে চ্যাটিংয়ের সূত্র ধরে প্রতারণার ফাঁদে পড়েন। প্রতারকরা টাকার দাবিতে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে এবং পরে পিটিয়ে হত্যা করে। পুলিশের এই দাবির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছে ইমতিয়াজের পরিবার। তারা পুরো বিষয়টি আরও তদন্তের দাবি করেছেন।
গত বুধবার (২৯ মার্চ) স্থপতি ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূঁইয়ার বাসায় প্রবেশ করতেই নিরাপত্তারকর্মীর জিজ্ঞাসা, কে আপনি? কোথায় যাবেন? পরিচয় পাওয়ার পর তিনি আর কিছু বলেননি। ইমতিয়াজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই ভবনে চাকরি নিয়েছি তিন মাস হবে। এই সময়ের মধ্যে স্যারের সঙ্গে সালাম বিনিময় ছাড়া কিছুই হয়নি। খুব কম কথা বলতেন। এতো ভালো মানুষ এভাবে হারিয়ে যাবে, সেটা আমরাও ভাবতে পারছি না।
সাইদুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিনও স্যার দুই মেয়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হন। আমি গেটে ছিলাম। সালাম দিলাম, উত্তর দিয়ে বের হয়ে যান। কিছু সময় পর স্যারের ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরেন। অন্যদিন স্যার দুপুরের পরে মেয়েদের স্কুল নিয়ে যেতেন। আর ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। কিন্তু সেদিন স্যারের ছেলে বাসায় আসলেও তিনি আসেননি। পরে শুনি নিখোঁজ হয়েছেন। তার কদিন পরেই লাশ উদ্ধারের খবর পাই।
ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূইয়ার স্ত্রী ফাহমিদা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঘটনার দিন আমাদের ১৫তম বিবাহবার্ষিকী পালন এবং শবে বরাতের রাতের নামাজ নিয়ে পরিকল্পনা করি। দুপুরের পরে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে বের হওয়ার সময় কিছু কিনতে হবে কিনা জানতে চান তিনি। আমি বলি কিছু লাগবে না। পরে দরজার সামনে থেকে বলেন, আমাকে ২০০ টাকা দাও, প্রিন্টের কাজটাও শেষ করে আসি। টাকা নিয়ে দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে যান। আর এভাবে ফিরবেন সেটা ভাবতে পারিনি। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফাহমিদা।
ফাহমিদা বলেন, আমাদের ১৫ বছরের সংসার জীবনে তার মধ্যে আমি এমন কিছুই দেখলাম না। সারাক্ষণ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যেই মানুষটা ভাবতো সে এমন কাজ করবে এটা আমি মানতে পারছি না। এটা তার লাইফস্টাইলের সঙ্গে মিলছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে বিষয়টা সামনে এনেছে, ওই ঘটনায় আরও তদন্ত দাবি করছি। কেউ এই হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এই নাটক সাজিয়েছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, আমাদের দুইজনের কোনও ডিভাইসে কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। সন্তানরাও তার বাবার ফোন ব্যবহার করতো। তবে কখনও এমন ধরনের কোনও অ্যাপ দেখিনি। করোনার সময় থেকে তার ও আমার মোবাইল-ল্যাপটপ সবসময় ছেলে মেয়েরা ব্যবহার করতো। এমন গোপন কিছু ব্যবহার করলে সর্তক থাকতেন। কিন্তু তেমন কিছুই না।
ফাহমিদা আক্তার জানান, ৮ মার্চ তেজগাঁও থানায় নিখোঁজের জিডি করতে গেলে থানা থেকে তার (ইমতিয়াজ) ফোন নম্বরের সর্বশেষ লোকেশন দেখা হয়। পরে কলাবাগান থানাধীন ধানমন্ডি ক্রিসেন্ট রোডের ওই বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। ওই বাসার সামনে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা আছে, ওটার ফুটেজ দেখলেও তার অবস্থান বোঝা যাবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখেছে কিনা জানতে পারিনি।
ফাহমিদার ভাষ্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রথম থেকেই আমার পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। তারা আমাদের লাশ উদ্ধারে অনেক সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু অবশেষে যে বিষয়টি সামনে এনেছেন, এটা আমার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। এই ঘটনায় আরও তদন্তের দাবি করি। এছাড়া প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি করেন ভুক্তভোগীর স্ত্রী।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কলাবাগানের ওই বাসা থেকে চিহ্নিত চক্রটি একটি অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরে বাসায় ডেকে নিয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে আসছিল। ইমতিয়াজ হত্যার সঙ্গে জড়িত ওই চক্রের সদস্য আরাফাত ফয়সাল আহমেদ রাহাত ওরফে হৃদয়, মিল্লাত হোসেন মুন্না, আলিফ, এহসান ওরফে মেঘ ও আনোয়ার হোসেনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে গত ২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জ থেকে মিল্লাত হোসেন মুন্নাকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কলাবাগান এলাকায় থেকে আনোয়ার হোসেন ও এহসান ওরফে মেঘকে আটক করা হয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, চক্রটি এভাবে ডেটিং অ্যাপের ফাঁদে ফেলে বহু মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আরাফাত আর আলিফ পালিয়ে আছে। তাদের গ্রেফতারে কাজ চলছে। যেহেতু মামলা তদন্ত করছে সিরাজদিখান থানা পুলিশ। এজন্য মামলার পুরো বিষয়টি তারাই দেখভাল করবেন। আমরা এই মামলার শুধু আসামি ধরে দিয়ে সহযোগিতা করেছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন