করোনায় আক্রান্ত বিশ্বে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে দাম তলানিতে নেমে আসলেও বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে ৪ বছর আগের দামেই। করোনায় বিশ্বজুড়ে অচলাবস্থা শুরুর দিকেই তেলের দাম পড়ে যায় আন্তর্জাতিক বাজারে। করোনায় একের পর এক দেশ লকডাউন এবং বিমান চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায় বিশ্বব্যাপী। গত ২০ এপ্রিল বিবিসি’র এক সংবাদে বলা হয়, তেলের দাম ইতিহাসে নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমেরিকাসহ বিশ্ব বাজারে তেলের দাম পড়ে গেছে। এমনকি তেল কিনলে পরে ক্রেতাদের ভোর্তোকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অথচ, বাংলাদেশে পূর্বের দাম অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিদেশের ব্যাংকে টাকার অঙ্ক স্পিথ রাখা। আর দেশের ভীরু জনগণ এক সময় বিএনপি আমলে তেলের দাম লিটারে একটাকা বৃদ্ধিতে রাস্তায় নামলেও এখন দশ টাকার তেল একশ’ টাকায় হাসিমুখে কিনছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) এর সদস্যভুক্ত দেশ গুলোর মধ্যে তেলের দাম নিয়ে আগে থেকেই বনিবনা ছিল না। এছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে ওপেক ও নন-ওপেক মিত্রদের দরদাম নিয়ে অমিলের সাথে যোগ হয় করোনা মহামারী। এতে তেলের দাম আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে আসায় অনেক দেশ উৎপাদন হ্রাস করে দিতে বাধ্য হয়।
করোনাকালে বিশ্বব্যাপী চাহিদায় রেকর্ড পতনের ফলে প্রতি লিটার পেট্রল ও ডিজেলের প্রকৃত দাম আন্তর্জাতিক বাজারে নেমে আসে বাংলাদেশী মুদ্রায় বিশ টাকারও কমে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি। হেরফের হয়নি জ্বালানী তেলের দামে। মেরুদন্ডহীন ক্রেতাদেরও কোন আপত্তি লক্ষ্য করা যায়নি। বিদুৎ না দিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা ভারত এবং সামিটকে ঘুষ দেয়ার কাহিনী বের হয়েছে এই আমার দেশের পাতাতেই। অথচ জনগণ টু শব্দ করতেও ভয় পেয়েছে।
এরপর বিশ্ববাজের জ্বলানী তেলে দামে ধ্বস নামলেও দেশের দামের কোন হেরফের করা হয়নি। নতজানু জনগণের সম্ভবত এটাই প্রাপ্য। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভর্তুকি দামে তেল দেয় সরকার। এছাড়া শুল্ক এবং তেল কোম্পানিগুলোর বাজারজাতকরণ খরচের কারণে খুচরা বাজারে এর দাম এখনও অনেক বেশি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ১১ অক্টোবরের হালনাগাদ তালিকা থেকে জানা যায়, বর্তমানে ডিজেল-৬৫, কেরোসিন-৬৫, পেট্রোল-৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিপিসি ৪ বছর আগে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম পুন:নির্ধারণ করেছিলো। এরপর আর দামের কোনো সমন্বয় করা হয়নি।
বিপিসির বিপণন বিভাগ থেকে জানা যায়, করোনাকালে লকডাউনের সময় শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও পরিবহন খাতে জ্বালানি চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে যায়। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৩ হাজার টন ডিজেল ব্যবহার হলেও তা কমে এসেছিলো ছয় হাজার টনে। এছাড়া, প্রতিদিন বিমানের জেট ফুয়েলের চাহিদা ১২৩৯ মেট্রিক টন থাকলেও তা কমে মাত্র ৮১ টনে নেমে যায়। পাশাপাশি, উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের চাহিদা।
সবকিছু বন্ধ থাকায় জ্বালানি তেলের ব্যবহার তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে হাতেগোনা কিছু পাম্প খোলা থাকলেও তাদের বিক্রি বলতে গেলে খুবই কম ছিলো। রাজধানীর পেট্রোল পাম্পগুলো চলেছে সীমিত আকারে।
তবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিবাজ সরকার বিদেশের ব্যাংকে তাদের সম্পদের পাহার গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশে তেল মজুদের সক্ষমতা:
বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে তেল সংরক্ষণের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এর সুফল নিতে পারছে না বাংলাদেশ। বিপিসি সাধারণত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েত থেকে আরব লাইট এবং মরবান তেল আমদানি করে থাকে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ চাহিদাই হচ্ছে ডিজেল। বর্তমানে ডিজেলে ৬ লাখ ২৮ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে মজুদ রয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার টন। খালাসের অপেক্ষায় চারটি অয়েল ট্যাংকারে আরও এক লাখ ২০ হাজার টন তেল রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজেল আমদানি হয়েছে ৮ লাখ ৮৯ হাজার টন এবং অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন। গতবছরের একই সময়ে যা ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ ৬১ হাজার টন এবং ৩ লাখ ৬৬ হাজার টন।
মজুদ বাড়াতে চায় বিপিসি:
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের নিম্নমুখী দামের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি বছর ৫০-৫৫ লাখ টন তেল কেনে বাংলাদেশ। এদিকে, সরকারিভাবে তেলের মজুদ সক্ষমতা রয়েছে তিন মাসের। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার সুযোগ কাজে লাগাতে চায় বিপিসি।
উল্লেখ্য, তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ফলে অনেক দিন ধরেই ভর্তুকি দেয়ায় লোকসান গুনছিলো বিপিসি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুযোগে মজুদ বাড়াতে পারলে লোকসান কাটানো সম্ভব হত বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।
বিশ্লেষকদের মতে, তেল মজুদে বেসরকারি খাতের সক্ষমতাকে কাজে লাগানো যায়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করলে এক বছরের চাহিদা সমান মজুদ করা সম্ভব।
তারা বলছেন, তেলের মজুদ বাড়িয়ে পণ্য ও সেবার উৎপাদন ব্যয় কমানো উচিত। কারণ ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সরকারি সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিপিসি কম দামে কিছু অতিরিক্ত পেট্রোলিয়াম জ্বালানি কেনার পদক্ষেপ নিয়েছে। এজন্য তারা নয়টি বেসরকারি কোম্পানির কাছে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল সংরক্ষণের জন্য ভাড়ার ভিত্তিতে তাদের সংরক্ষণাগারের সুবিধাগুলো ব্যবহারে যোগাযোগ করেছিল। বর্তমানে ওই কোম্পানিগুলো তাদের সংরক্ষণাগারগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বা শোধনাগার ব্যবসার জন্য ব্যবহার করছে।
কিন্তু দুর্নীতিবাজ সরকার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একদিকে তেলের মজুদ কমিয়ে রাখা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ না কিনেই সরকার সমর্থক কোম্পানী গুলো এবং ভারতকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে হাজার হাজার কোটি টাকা কমিশন হিসাবে প্রদান করা। এখানে উল্লেখ্য, এই কমিশনের অধিকাংশ অর্থ সরকার প্রধান এবং তাঁর পরিবারবর্গ ভাগাভাগি করে নেন। সাম্প্রতিক সময়ে তেলের মূল্যহ্রাস এই দুর্নীতিবাজ শ্রেনীর জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি সরকারের ওই দুনীতিতে সরাসরি ভাবে সহায়তা করছে। ভারতকে খুশি করতেই এই সমস্ত আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ভারতপন্থি বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী সরকারকে দুর্নীতিতে সকল রকম সহায়তা দিয়ে চলেছে। আর এই ঋনের বোঝা বহন করতে হচ্ছে দেশের সাধারণ দরিদ্র জনযোষ্ঠিকে। বাংলাদেশে কোনদিন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে শেখ হাসিনার সঙ্গে এই সমস্ত দুর্নীতিতে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকেও জবাবদিহি করতে হবে।
আরো উল্লেখ্য যে সরকারের রাজস্ব আয়ে ধ্বস নামায়, জনগণের পকেট কেটে জ্বালানী তেলের মূল্য ৪/৫ গুণ বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি মিটানো হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ হরর মুভির মত প্রাণহীন জম্বিতে পরিণত হওয়ায় সরকারের এই অপকর্মের কোন প্রতিবাদ করতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন