অপরাধীদের ধরতে ‘সোর্সনির্ভর’ তদন্ত করে পুলিশ। সোর্সদের দেওয়া তথ্য নিয়ে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করে। কোনো অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে পুলিশ সোর্স নিয়োগ করে। সোর্সের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় এসব সোর্স নিজেদের পুলিশ পরিচয় দেয়। এলাকায় মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটও এ সোর্স নিয়ন্ত্রণ করে। নিজেদের আর্থিক সুবিধা বা অনৈতিক সুবিধার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের মিথ্যা তথ্য দেয়। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাই ফেঁসে যায়। অনেক সময় পুলিশ জেনেশুনে সোর্সদের দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ ওঠে। আবার অপরাধীদের গ্রেফতারের পেছনের তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে সোর্সদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয় সোর্স। খুন হয় সোর্স।
২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবী থানায় পুলিশের হেফাজতে জনি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পাঁচ আসামির মধ্যে তিন জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। অপর দুই জনকে দেওয়া হয় সাত বছরের কারাদণ্ড। যে দুই জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তারা মূলত পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করছিলেন।
পল্লবী থানায় গত ২৯ জুলাই যে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়, সেটি ভবনের দোতলায় পরিদর্শক (তদন্ত) ইমরানুল ইসলামের কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন পুলিশের সোর্স রিয়াজুল। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে সোর্স রিয়াজুলের এক হাতের কবজি উড়ে যায়।
গত ৬ সেপ্টেম্বর রাতে পূর্ব রাজাবাজারের রাতুল ও তার তিন সহযোগী দুটি মোটরসাইকেলে করে র্যাব সোর্স আবুল কাশেমের পিছু নেন। একপর্যায়ে তারা শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের সামনের রাস্তায় কাশেমকে ধরে ফেলেন। তারা কাশেমকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যার পর পালিয়ে যান। এ ঘটনার চার দিন পর র্যাব তদন্ত করে রাতুল, মাসুদ হোসেন, রেজাউল করিম ও রুবেল হোসেনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, রাজাবাজার এলাকায় এক মাস আগে কাশেম মাদক ব্যবসায়ী নুরজাহানকে র?্যাবের কাছে ধরিয়ে দেন। নুরজাহানের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া রাতুলের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এর জের ধরে রাতুল র্যাব সোর্স কাশেমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
২০১৬ সালের ২৩ মে টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের টিঅ্যান্ডটি গেট এলাকায় পুলিশের সোর্স কুতুব উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মাদক ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেওয়ায় একই বছরের ৬ মে টঙ্গীর এরশাদনগরে পুলিশের সোর্স রাসেল মিয়াকে খুন করা হয়। ঐ বছরের ২২ মে খুন হন পুলিশের আরেক সোর্স মমিন।
সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, অপরাধীদের সঙ্গে যাদের ওঠাবসা, অপরাধীদের খোঁজখবর রাখে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তি সোর্স হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করার কাজটি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব। ঐ পুলিশ কর্মকর্তা যদি নিজে সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে না পারেন, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা এটা যদি বুঝতে না পারেন, তার জন্য দায়ী ঐ পুলিশ কর্মকর্তা। সোর্সের গতিবিধি, চরিত্র ও মানসিকতা বুঝতে হবে। তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সোর্সই ঐ পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা ঐ কর্মকর্তার সমস্যা। এখানে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সোর্স নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ব্যাপারে পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেন, পুলিশের সোর্স প্রায়ই নিজ স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ সোর্সদের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে, তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই না করেই অভিযান চালায়। এতে অনেক নিরপরাধ মানুষ মামলার শিকার হয়ে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়।
সোর্স কারা : সাধারণত রাজনৈতিক দলের কর্মী, বিভিন্ন ছোট অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামি, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিকে পুলিশ সোর্স হিসেবে ব্যবহার করে। একজন সাধারণ মানুষও সোর্স হতে পারে। আবার কোনো বিজ্ঞজনও হতে পারেন সোর্স। কখনো কোনো ঘটনা বা চক্রে জড়িত কাউকেও সোর্স করা যেতে পারে। তবে এটি পুরোটাই নির্ভর করে কর্মকর্তার দক্ষতা বা কৌশলের ওপর। বড় ধরনের অপরাধীর তথ্য বের করতে পুলিশ সোর্স নিয়োগ দেয়। সেক্ষেত্রে তাকে আর্থিক সুবিধা দিতে হয়, যা সোর্স মানি হিসেবে পরিচিত। যদিও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যখন এ টাকা দেওয়া হয়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে ‘অপারেশন মানি’। সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি বা প্রবিধান না থাকায় এটি জবাবদিহিতার বাইরে থেকে যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন