দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তার ছেলে ও যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম ইসলাম।
মঙ্গলবার বাদ জোহর নুরুল ইসলামের জানাজার আগে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় দেশের জন্য তার বাবার অবদানের কথা স্মরণ করেন। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময় দেশের কল্যাণে নুরুল ইসলামের অবদানের কথা স্মরণ করেন। বাবার বিদেহী আত্মার শান্তি ও বেহেশত কামনায় সবার কাছে দোয়া চান শামীম ইসলাম।
রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্ক প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শুরু হয় বেলা ১টা ৪২ মিনিটে। শেষ হয় ১টা ৪৫ মিনিটে। এতে ইমামতি করেন যমুনা ফিউচার পার্ক মসজিদের ইমাম ও খতিব মুফতি ইয়াকুব শরীফ।
জানাজায় মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। এই কঠিন সময়েও তার জানাজায় বহু মানুষের সমাগম ঘটে। সবাই নুরুল ইসলামের পরকালীন শান্তি কামনায় দোয়া করেন।
এ সময় শামীম ইসলাম বলেন, আজকে আমরা যেখানে এই জানাজায় দাঁড়িয়েছি, সেটি আমার বাবার নিজ হাতে তৈরি করা প্রতিষ্ঠান। গত ৪৫ বছরে তিল তিল পরিশ্রম করে এমন আরও বহু প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন, যা দেশকে এগিয়ে নেয়ার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য বড় ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করছে।
দেশের কল্যাণে কর্মপ্রাণ ও সফল উদ্যোক্তা বাবা নুরুল ইসলামের অবদানের কথা স্মরণ করে শামীম ইসলাম বলেন, যে উন্নয়নের চাকা তিনি গড়ে দিয়ে গেছেন, আমাদের দায়িত্ব সেই চাকাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করছি, যাতে আমার বাবা যা করে গেছেন, তা ধরে রাখতে পারি এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
তিনি আরও বলেন, আমার বাবার এই অগ্রযাত্রা সহজ ছিল না। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষা পার করে তাকে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আপনারা তাকে ভুল বুঝতে পারেন, আঘাত পেতে পারেন, কিন্তু আমি তার ছেলে হিসেবে তার পক্ষ থেকে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আশা করি, আপনারা সবাই আমার বাবাকে ক্ষমা করে দেবেন।
‘আপনারা যারা আমার বাবার কাছাকাছি ছিলেন, কাছ থেকে দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন উনি কাজকে কতটা ভালোবাসতেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত আমাদের ভবিষ্যৎ পথ চলার দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তিনি। বাবা মিথ্যা অপছন্দ করতেন, কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা রাখতেন সেটি নিশ্চয়ই আপনারা স্বীকার করবেন।’
শামীম ইসলাম বলেন, বাবাকে যেন আল্লাহ বেহেশত নসিব করেন, তার মাগফিরাত কামনা করে সবাই দোয়া করবেন।
এর আগে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে নুরুল ইসলামের গোসল সম্পন্ন করা হয়। জানাজার পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
এর পর বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার লাশ দাফন করা হয়েছে।
সোমবার বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পপতি নুরুল ইসলাম।
গত ১৪ জুন নুরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বিশিষ্ট এই শিল্পোদ্যোক্তার চিকিৎসায় এভার কেয়ারের আইসিইউ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহবুব নুরের নেতৃত্বে ১০ সদস্যবিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
এর বাইরে চীনের তিনটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন।
১৯৪৬ সালে নবাবগঞ্জের চুড়াইন ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নুরুল ইসলাম। তার বাবার নাম আমজাদ হোসেন। মায়ের নাম জমিলা খাতুন।
তার স্ত্রী সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বর্তমান জাতীয় সংসদের এমপি সালমা ইসলাম। ছেলে শামীম ইসলাম যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার তিন মেয়ে- সোনিয়া ইসলাম, মনিকা ইসলাম ও রোজালিন ইসলাম যমুনা গ্রুপের পরিচালক।
২৫ বছর বয়সে নুরুল ইসলাম দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া নুরুল ইসলাম যুদ্ধের পর দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মন দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন। একজন সাহসী ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলেন বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
১৯৭৪ সালে তিনি যমুনা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। মেধা, দক্ষতা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার মাধ্যমে একে একে শিল্প এবং সেবা খাতে গড়ে তোলেন ৪১টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে লক্ষাধিক মানুষের। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন আজ দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম, যা ব্যাপক পাঠক ও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে সারাটি জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন শিল্প খাতের এই সফল ‘আইকন’।
এই মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
অভিভাবকের মৃত্যুতে যুগান্তর পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। তার মৃত্যুতে দেশের শিল্প খাতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় অসময় চলে গেলেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন