বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিতে রাজনৈতিকভাবে লাভ দেখছে দু’দলই। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনে করে, এ মুক্তির মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদারতার পরিচয় দিয়েছেন; যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। তার এ সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী বলেও মনে করছেন তারা।
অন্যদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সরাসরি স্বাগত না জানালেও স্বস্তি প্রকাশ করেছে বিএনপি। যদিও পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসনের মুক্তি হয়েছে তাতে দলটির নেতাকর্মীরাও লাভ দেখছেন। তারা মনে করেন, সরকারই খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে। এটি আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে তার প্রাপ্য। সেই অধিকারই বাস্তবায়িত হল। পাশাপাশি দীর্ঘদিন পর চেয়ারপারসনকে কাছে পেয়ে নেতাকর্মীরাও উজ্জীবিত হবেন। দুর্নীতির দায়ে দুই বছরের বেশি সময় সাজা ভোগের পর ‘মানবিক বিবেচনায়’ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য বুধবার মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
দুই দল ছাড়াও দেশের সুশীল সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং শ্রেণি-পেশার মানুষও সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশও সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচকভাবে দেখছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেরিতে হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা ইতিবাচক ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দুই দলের সৃষ্ট দূরত্ব কিছুটা হলেও কমতে শুরু করবে; যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এ মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাসের মতো মহামারী মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। জাতিকে বাঁচাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তির মধ্য দিয়ে তা অনেকটা সহজ হবে। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতেও এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। খালেদা জিয়ার মুক্তি নিঃসন্দেহে রাজনীতির জন্য একটা সুসংবাদ। দেরিতে হলেও তাকে মুক্তি দিয়ে সরকার উদারতার পরিচয় দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সরকার লাভবান হবে। অন্যদিকে বিএনপিও তাদের নেত্রীর মুক্তিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। যেভাবেই হোক তারা তাদের নেত্রীকে কাছে পেয়েছেন। এর ফলে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব তৈরি হবে।
জাফরুল্লাহ বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির মধ্য দিয়ে দেশে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরল। এখন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্য হওয়া উচিত।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিতে রাজনৈতিকভাবে লাভ দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদারতা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি আরও বেড়েছে। যে পরিস্থিতিতেই খালেদা জিয়ার মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হোক না কেন, তা নিয়ে কেউ সমালোচনা করতে পারবে না। বাস্তবতার নিরিখে সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মানবিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। আমরা আশা করি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ও বিএনপি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার নিকটাত্মীয় তার মুক্তি চেয়ে বাংলাদেশের নির্বাহী প্রধানের কাছে আবেদন করেছিলেন। তিনি বিষয়টি সদয় বিবেচনায় নিয়ে মানবিক কারণে ৬ মাস সাজা স্থগিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মানবিক জায়গা থেকে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান করোনাভাইরাসও একটি বিষয়; যাতে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় থাকে। তিনি যাতে সুস্থ থাকেন সে বিষয়টিও মাথায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একই বিষয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের উদ্যোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচয় দিয়ে উদারনৈতিক মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সরকারপ্রধান হিসেবে বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে মুক্তি দিয়েছেন। আশা করি, বিএনপি এ বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে আমাদের সবার অভিন্ন শত্রু করোনা মোকাবেলায় সরকারের সর্বাত্মক ও সম্মিলিত উদ্যোগে সহযোগিতা করবে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবেদন জানানো হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা ৬ মাসের জন্য স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা এতদিন ধরে নেতিবাচক রাজনীতি এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করে আসছিলেন। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর উদারতার কারণে সেটি থেকে বিএনপি ফিরে আসবে।
খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিএনপির ভেতরে এক ধরনের বিশ্লেষণ চলছে। দলটির নেতারা মনে করেন, অসুস্থ খালেদা জিয়া সরকারের জন্য একটা টাইমবোমা ছিল। তাকে সরকার কারাগারে রেখে যে সংকটে অথবা ঝুঁকিতে ছিল, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে সেখান থেকে আপাতত তারা ‘রিলিজ’ হল। পাশাপাশি রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার যে আপসহীন নীতি তা অটুট থাকল। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালত নয়, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই আটকা ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা উজ্জীবিতভাব ফিরে এসেছে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আমরা তার মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছি, আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করেছি। দেশনেত্রীর পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য তার সাময়িক মুক্তির জন্য আবেদন করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে। এতে দেশের মানুষ এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা স্বস্তিবোধ করছেন। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার তার চিকিৎসা। তাকে সুস্থ করে তোলা। সেটাই আমরা চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি ঘরোয়া পরিবেশে তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।
তিনি বলেন, এ মুক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের চেয়ারপারসন তার দীর্ঘদিনের ‘আপসহীন’ ইমেজ অক্ষুণ্ন রেখেছেন। দীর্ঘকাল পরে খালেদা জিয়া আইনগতভাবে, সাংবিধানিকভাবে তার যেটা প্রাপ্য সেই মুক্তি তিনি পেয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমরা আমাদের দলীয় ফোরামে করব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, ম্যাডামের মুক্তিতে সবার মধ্যে একটা স্বস্তি এসেছে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রাজনীতি, গণতন্ত্র, বিধিবিধান, আইনের শাসনের অভাব আদালতের ভূমিকা যেখানে গৌণ, সেখানে আমাদের ব্যর্থতার দায়ও আছে। আইনি লড়াইয়ের ব্যর্থতার কথা বলব না। তবে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন রাজনৈতিক নেত্রী, যার নেতৃত্ব রাজপথেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- তার মুক্তির ব্যাপারে আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। পরিবেশ পরিস্থিতি ‘এলাউ’ না করুক আমরা যে পারিনি এটা তো সত্য। এ নিয়ে লাভ-লোকসানের হিসাব করা অনধিকার চর্চা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন