কালের কণ্ঠ: বাংলাদেশে জঙ্গি সন্দেহভাজনদের ৫৬ শতাংশই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (গ্র্যাজুয়েট) সম্পন্ন করা। গবেষণায় দেখা গেছে, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদে জড়িতদের ৮২ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। বিষণ্নতা, একাকিত্ব জঙ্গিবাদে জড়ানোর অন্যতম কারণ। দেশে যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের। তারা তাদের মতাদর্শী ধর্মীয় নেতা ছাড়া অন্য কারো কথা বিশ্বাস করে না। এ ছাড়া সঠিক ব্যাখ্যা না জানায় অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাই সঠিকভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন দেশের আলেমসমাজ বা ধর্মীয় নেতারা। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) উগ্রবাদবিরোধী জাতীয় সম্মেলনে বক্তাদের বক্তব্যে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), ইউএস-এইড ও জাতিসংঘের আয়োজনে দুই দিনের এই সম্মেলনের গতকাল ছিল শেষ দিন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘পরিবারের উচিত সন্তানরা কী করছে সেদিকে খেয়াল রাখা। সন্তানদের সব সময় ভালো কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে, যাতে তারা উগ্রবাদে জড়িয়ে না পড়ে। যে যুবকদের নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি, তাদের মেধা আছে। এই মেধা যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর যারা ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ভার্চুয়াল জগতে সারাক্ষণ থাকে, তারা কোনো কিছু দেখলে তা বিশ্বাস করার আগে বিষয়টি যাচাই করে নেওয়া উচিত।’
মন্ত্রী আরো বলেন, ‘সব কটি ঘটনা পর্যালোচনা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এগুলো আমাদের দেশীয় সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে আমরা একটা পর্যায়ে চলে এসেছি। এ ভূখণ্ডের হাজার বছরের ইতিহাসে জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ ছিল না। তারা (জঙ্গিরা) বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা উগ্রবাদীদের চিহ্নিত করি, মামলা দিই, গ্রেপ্তার করে কারাগারে দিই; কিন্তু কারাগারে তাদের সংশোধন হচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারিভাবে কারাগারে জঙ্গিদের ডি-র্যাডিকালাইজ করা দরকার। যারা জামিনে ফিরে আসছে তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করতে হবে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে মোটিভেশনাল কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে এ কাজটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরভাবে করেন ধর্মীয় নেতারা। তাঁদের বাণী মানুষ খুব সহজে গ্রহণ করেন।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি যখন অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটে ছিলাম তখন দেখেছি, উগ্রবাদে জড়িত ৯০ শতাংশ আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের। তারা আলেমসমাজের একাংশকে ‘কাফির’ বলে মনে করে। এদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা বলেছে, শুধু তাদের সম্প্রদায়ের বড় হুজুরের কথা শুনবে ও মানবে তারা। তাই উগ্রবাদ রুখতে ধর্মীয় নেতাদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।” ২০১৬ সাল থেকে জঙ্গি সন্দেহভাজন হিসেবে আটকদের নিয়ে করা একটি গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করে সিটিটিসির উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, এদের ৫৬ শতাংশই ছিল বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (গ্র্যাজুয়েট) সম্পন্ন করা। অনেকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীও। এ বছরের এপ্রিলে ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় হামলাকারীদের অধিকাংশই ছিল উচ্চশিক্ষিত। ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালে জঙ্গি হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ। সিটিটিসি ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদে জড়িতদের ৮২ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। তিনি আরো বলেন, ২০১৬ সালে ‘দাওয়া ইলাল্লাহ’ নামের একটি উগ্রবাদী ফোরামের সদস্য ছিল ৫৫০ জন। বর্তমানে তাদের সদস্যসংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। সংখ্যায় বৃদ্ধি পেলেও দেশের জঙ্গি কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে কমেছে। ২০১৬ সালের তুলনায় জঙ্গি কার্যক্রম কমেছে ৯০ শতাংশ।
সভাপতির বক্তব্যে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গি দমনে সরকারি-বেসরকারিভাবে কাজ করতে হবে। তবেই সাফল্য আসবে। উগ্রবাদের বীজ সমাজ থেকে নির্মূল করতে পারলে, জঙ্গিবাদের মাথাচাড়া বন্ধ করতে পারলে টেকসই সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন