ভারতীয় পাররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে স্বাগত জানাচ্ছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন (ডানে)
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দু’দিনের বাংলাদেশ সফর ছিল দক্ষিণ এশিয়া সফরের শুরুর সূচনা এবং তা ছিল বেশ নিম্নপর্যায়ের ব্যাপার।
ভারতের প্রতিবেশীরা যতটুকু পছন্দ করে এই সফরের সময় এই অঞ্চলের পরিস্থিতি সার্বিকভাবে তার চেয়ে বেশি গোলযোগপূর্ণ থাকলেও মিডিয়ায় সেই তাপ ছিল না।
আরো পড়ুনঃ রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমাদেরকে কি ছাড়িয়ে গেছে চীন?
মিডিয়ায় বক্তব্য রাখার সময় জয়শঙ্কর বিশাল বন্ধুত্বে পরিতৃপ্ত হওয়ার কোনো দাবিও করেননি। তিনি স্থলবন্দর, সীমান্ত নিরাপত্তা ইত্যাদিতে অর্জনের পাশাপাশি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি ও আসামের অবৈধ অভিবাসী ইস্যুর মতো বেশ কণ্টকাকীর্ণ বিষয়গুলোও উল্লেখ করেছেন।
দ্বিপক্ষীয় ইস্যু ও ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি
জয়শঙ্কর বলেন, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপির) আমলেই তিস্তার সমাধানে পৌঁছার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির প্রতিশ্রুতির প্রতি ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এক প্রশ্নের জবাবে আসাম অনুপ্রবেশ ইস্যু নিয়ে তিনি বলেন, এটি ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ তিস্তা নদীর পানি নিয়ে প্রতিশ্রুতিটি আসলে উন্মুক্ত। কারণ মোদির প্রথম আমলে কেন ভারতের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি এবং কেন তা দ্বিতীয় মেয়াদে পৌঁছলো এমন প্রশ্নের ব্যাখ্যা তিনি দেননি। এই পথে নিশ্চিত বাধা হলো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
আসাম প্রশ্নে তিনি যে জবাব দিয়েছেন, তা ঢাকার আশঙ্কা সামান্যই প্রশমিত করতে পারে। খুবই সম্ভব যে এ ধরনের বিষয় অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে আলোচিত হবে। কাশ্মীর ইস্যুটিও ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এটি এই অঞ্চলে অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে এবং বাংলাদেশের জন্যও অস্বস্তি সৃষ্টির কারণ হয়েছে।
এদিকে কাশ্মীর ইস্যুটি দক্ষিণ এশিয়ার অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছে, এটি সম্ভবত খুব শিগগিরই বিলীন হবে না।
নিরাপত্তাহীনতার এই অনুভূতির কারণ আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যহীনতা। এই অঞ্চলের প্রধান দেশ হলো ভারত। দেশটি অন্য সব দেশের চেয়েও বড়। এটিই স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।
আসাম: অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিদেশে প্রভাব?
আসামের ‘অবৈধ মুসলিম-বাংলাদেশী’ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে পরবর্তী পদক্ষেপটিই মুখ্য। ভারত এটিকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য যে বিপুল শক্তি ও ব্যয় করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই কেবল গবেষণামূলক বা চাপ সৃষ্টিমূলক হতে পারে না। আর তারা যেহেতু ইতোমধ্যেই ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তারা বিশেষভাবে মুসলিম ও বাংলাদেশ থেকে আসায়, এ ধরনের লোকদের ভাগ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি মোকাবিলা করার কোনো পরিকল্পনা কি বাংলাদেশের আছে?
রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময় বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। ১৯৭৭ ও ১৯৯২ সালে দুটি বড় ধরনের বহিষ্কারের পর কেন এমনটা হলো তা পরিষ্কার নয়। রোহিঙ্গারা ১৯৮৪ সালে নাগরিকত্ব হারানোর মানে ছিল এসব লোক অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের পথে আরেকবার পথিক হবে। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো প্রস্তুত হয়নি। এই প্রশ্নের জবাবে সব নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র দফতর মুখ বন্ধ করে রাখে।
কিন্তু সমস্যাটি দূরে সরে যায়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমিনকে আসাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হওয়ায় তারা এটি নিয়ে ভাবেননি। ১১ লাখ রোহিঙ্গা যেভাবে বাংলাদেশে এসেছে, আরেক ৪০ লাখ কি আসবে এখানে?
জয়শঙ্কর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা যখন এসেছিল, তখন কিন্তু বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি ভারত। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারতে অন্যান্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় ছিল, বিশেষ করে বাণিজ্য ও মিয়ানমারের মাধ্য উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের প্রশমিত করা।
আসাম প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়
আসামে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
নাগরিকত্ব হিসাব সম্পন্ন হওয়ার পর অবৈধদের চিহ্নিত করার পর ভারত আর কত দিন বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখবে, এত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো সমাধান না করে থাকতে পারবে?
যখন ঠেলে দেয়াটা বাস্তবতায় পরিণত হবে তখন বাংলাদেশের পক্ষে কী করা সম্ভব হবে? যেকোনো বিবেচনাতেই ৪০ লাখ লোককে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
এতে কি এই অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং চীনসহ প্রধান প্রধান বৈশ্বিক খেলোয়াড় আসরে নামবে? এতে কার ক্ষতি কার লাভ?
সব হিসাবেই আসাম প্রশ্নে ভারত একটি চাল চেলেছে এবং সে নিরাপদ থাকবে। বিশ্বের কাছে বা অন্য কোনো শক্তির কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বহীন হওয়ায় এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোনো শক্তি থাকবে না। ভারত তা জানে এবং সম্ভবত বাংলাদেশও তা জানে।
রোহিঙ্গা উচ্ছেদের পরও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে দারুণ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ভারত আরো বড় পক্ষ হওয়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রবল ঢলের পর সরকার/রাষ্ট্রের সামর্থ্য কতটা জোরালো থাকবে, তা দেখার বিষয়। তবে এ ধরনের পদক্ষেপের আকস্মিক মূল্য অনেক।
দুই দেশের কেউ যে এসব বিষয় নিয়ে ভাবছে, তার কোনো ইঙ্গিতই সফরকারী ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেননি। কাশ্মীর পাকিস্তানকে প্রভাবিত করেনি, ৪০ লাখ উদ্বাস্তু বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের অস্তিত্বগত হুমকির সৃষ্টি করবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন