(বাম থেকে) অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আবদুল আলীম চৌধুরী ও ডা. মোহাম্মদ আবদুল জাব্বার
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকেই সিলেট মেডিকেল কলেজ সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। এসব কিছু বুঝেই হাসপাতালে গঠন করেন ব্লাড ব্যাংক ও ইমার্জেন্সি স্কোয়াড। হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় আতঙ্কিত মেডিকেল কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-ডাক্তাররা শহরতলিতে আশ্রয় নিতে শুরু করলে একপর্যায়ে হাসপাতাল প্রায় চিকিৎসক শূন্য হয়ে পড়ে। ডা. শামসুদ্দীন নারী নার্সদের হাসপাতাল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। নিজের মা, বড় মেয়ে, মেয়ে জামাই, বড় ছেলে ও ছোট দুই মেয়েকেও পাঠিয়ে দেন গ্রামে। তবে স্বামীকে সাহায্য করার জন্য শহরে থেকে যান স্ত্রী হোসেন আরা আহমেদ, যিনি ছিলেন সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। হাসপাতালে আহতদের সেবার জন্য ডা. শামসুদ্দীনের সঙ্গে থেকে যান ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী ও নার্স মাহমুদুর রহমানসহ আরও কয়েকজন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি চলে যাই, তবে মুক্তিবাহিনীর লোকদের সাহায্য করবে কারা?’
ডা. শামসুদ্দীন হাসপাতালে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটকে সাহায্য করতে থাকেন। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও সরবরাহ করছিলেন। তার চাচা মৌলভি মঈনউদ্দিন হোসেন হাসপাতালে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি হেসে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখনই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তাছাড়া জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়।’
ডা. শামসুদ্দীন ও তার পরিবার
কিন্তু ভুল ভেবেছিলেন অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন। ৯ এপ্রিল মেজর রিয়াজসহ পাকসেনারা হাসপাতালে ভেতরে ঢুকে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে না পেয়ে হাসপাতালে যারা রয়েছে তাদেরই বাইরে এনে গুলি করার নির্দেশ দেন। ডা. শামসুদ্দীন নিজের পরিচয় দিলেও কাজ হয়নি, গুলি করা হয় তাকে। প্রথম গুলিটি লাগে তার বাম উরুতে। দ্বিতীয় গুলিটি যখন তার পেটে, তখনও তিনি দাঁড়িয়ে। তৃতীয় আরেকটা গুলি হৃদপিণ্ডে লাগতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করতে তার সঙ্গে থেকে যাওয়া ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী, নার্স মাহমুদুর রহমান, পিয়ন মো. মহিবুর রহমান, মকলিসুর রহমান— কেউই রেহাই পাননি পাকবাহিনীর হাত থেকে।
পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন ডা. রফিক আহমেদ। পরিবারের সবাই তাকে গ্রামে চলে যাওয়ার কথা বললে ডা. রফিক বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাইরে বোম্বিং হচ্ছিল, কিন্তু ফেনী হাসপাতালের ভেতরে আমি রোগীর চিকিৎসা করেছি। ওরা ডাক্তারদের মারে না। তাছাড়া আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আমি গেলে হাসপাতালের রোগীদের কী হবে?
ভুল ভেবেছিলেন ডা. রফিকও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে পারলেও বাঁচতে পারেননি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা থেকে। তারা যখন ডা. রফিককে নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার ছোট দুই ছেলে তার সঙ্গে বের হলে ওদের জবাই করে হত্যা করা হয়। সঙ্গে রেলওয়ে হাসপাতালের হেড ক্লার্ককেও। তাদের চিৎকারে খাটের নিচে আর লুকিয়ে থাকতে পারেনি বড় ছেলে। বেরিয়ে এলেও তাকেও মেরে ফেলে পাকবাহিনী। আর ডা. রফিককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।
একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে দিনাজপুর সদর হাসপাতালের সহকারী সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবদুল জাব্বারকেও। তিনি বলতেন, ‘আরে, ডাক্তারের কোনো শত্রু আছে নাকি।’ সেই বিশ্বাস থেকেই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য থেকে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তাদের ছেড়ে যাওয়া ডা. আবদুল জাব্বারের কাছে ছিল চরম দায়িত্বহীনতার সামিল। কিন্তু সেই ডাক্তারকেই পরে হাসপাতালে ডেকে নিয়ে তার নিজ কক্ষে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
ডা. আব্দুল আলীম ও তার পরিবার
৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর, বিকেল সাড়ে ৪টা। ভারতীয় বোমারু বিমান আঘাত হানছে পাকিস্তানি ঘাঁটির ওর। ২৯/১ পুরানা পল্টনের বাসার দোতলার সামনের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে সেই দৃশ্য দেখছিলেন ডা. আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আবদুল আলীম চৌধুরী, যিনি ডা. আলীম চৌধুরী নামেই পরিচিত। সেদিন বোমা হামলা দেখতে দেখতে পাশে থাকা স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীকে বলছিলেন, ‘দেখো, ভারতীয় বিমানগুলো ইচ্ছামতো বোমা ফেলছে। মনে হচ্ছে, যেন এটা ওদের আকাশসীমা। আর এখনও মওলানা মান্নান বলে কিনা আমেরিকা ওদের রক্ষা করবে। সপ্তম নৌবিহার নিয়ে ওরা এসে গেছে!’
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, কথাগুলো বলছিল আর প্রাণ খুলে হাসছিল। কয়েক মিনিট পরই আমরা একটা গাড়ির শব্দ পেলাম। দাঁড়িয়ে দেখি, মাটি লেপা ছোটমতো একটা মাইক্রোবাস এসে আমাদের বাসার নিচের তলার গেটের সামনে দাঁড়িয়েছে। তখন ছিল কারফিউ। কারফিউর সময় এ গাড়ি দেখেই বুঝতে পারলাম, এটা পাকিস্তানিদের গাড়ি। সেদিন ওরা আলীমকে নিয়ে গেল। পরে জেনেছিলাম, বিকেল ৪টার দিকে ডা. রাব্বীকেও নিয়ে গেছে। ওরা আর ফিরল না। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর অনেক খোঁজাখুঁজির পর রায়েরবাজর বধ্যভূমিতে আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে পাওয়া গেল আলীমের লাশ।
প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা বইয়ে স্মৃতিচারণ অংশে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলছেন, নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার এসব বুদ্ধিজীবীদর ওপর কী পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়েছিল, তা যারা দেখেনি তাদের বোঝানো কষ্টকর! আলীম বহু চাঁদা উঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। গাড়ির বনেট ভর্তি করে ওষুধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিত।
‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ’ বইয়ে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন শহিদ হওয়া এমন সব চিকিৎসকদের কথা। বিভিন্ন প্রকাশনা, মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও স্মৃতিকথা থেকে এই বইটি সংকলন করেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) পরিচালক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ।
২০০৯ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে উঠে এসেছে ১০০ জন চিকিৎসক ও ১৫ জন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর ভূমিকার কথা। তুলে ধরা হয়েছে তাদের কী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকহানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর আল-শামস, রাজাকাররা। বইটিতে অবশ্য কেবল সেই সময়ের রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের কথাই উল্লেখ করতে পেরেছেন বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। কিন্তু এর বাইরেও আরও শত শত চিকিৎসক দেশের আনাচে-কানাচে সার্বক্ষণিক সহায়তা করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদেরও খুঁজে খুঁজে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী।
ঢাকা মেডিক্যালের নতুন ভবনের নিচতলার প্রবেশমুখে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ চিকিৎসক, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মৃতিফলক
অথচ চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের চতুর্থ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং কখনোই আক্রমণের শিকার হবেন না। বরং হাসপাতাল নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেই জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, পরিকল্পিতভাবে বেছে বেছে চিকিৎসকদেরও হত্যা করা হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলায় হাসপাতালের প্রবেশমুখেই রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ চিকিৎসক, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম ও ছবি সম্বলিত স্মৃতিফলক। ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা স্মৃতিফলকটিতে রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শহীদ হওয়া ৮১ জন চিকিৎসক ও ১৭ জন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর নাম।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, শহীদ অধ্যাপক আলীম চৌধুরী ওই সময় সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য বেশিরভাগ সময় থাকতেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার আবাসিক সার্জন ডা. আজহারুল হক বহির্বিভাগ দিয়ে নানা কৌশলে হাসপাতালে ঢোকাতেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। আর হাসপাতালে চিকিৎসারত মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করতেন ডা. ফজলে রাব্বী।
ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, এ দু’জন ছাড়াও অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফীর মতো চিকিৎসকরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করেছেন যেন মুক্তিবাহিনীর ইউনিট হিসেবেই। তাদের সবাইকেই নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
ডা. বায়জীদ সারাবাংলাকে বলেন, এই বইয়ে একশ জন চিকিৎসকের স্মৃতিচারণ করেছেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করা সহজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বাংলাদেশের প্রতিটি হাসপাতালে, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে ওষুধ আর অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। এসব গাড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করেছেন— এমন উদাহরণও রয়েছে। এসব চিকিৎসকরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়ে জীবন বাঁচিয়ে এবং নিজেরা জীবন দিয়ে আমাদেরকে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে গিয়েছেন। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ছবি: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ থেকে সংগৃহীত
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন