প্রভাষ আমিন
সম্প্রতি আমি দুটি বই পড়েছি। বই দুটি পুরোনো। কিন্তু আমি পড়েছি বিলম্বে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এএকে নিয়াজির লেখা ‘দ্যা বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ এবং মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হোসেন রাজার লেখা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’।
ইশারা-ইঙ্গিতে দুজনই স্বীকার করেছেন, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর দিনের পর দিন বঞ্চনা আর নির্যাতনের কারণেই পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লুকিয়ে ছিল পাকিস্তানের জন্মের ইতিহাসেই। ২০০ বছরের ব্রিটিশ রাজের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য ভারত আর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। ধর্ম ছাড়া দুই পাকিস্তানে আর কোনো মিল ছিল না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ঐতিহ্য সবকিছুই ছিল আলাদা।
পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল আর মানসিক দূরত্ব ছিল অলঙ্ঘনীয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করলেই, শাসন ক্ষমতা ছিল পশ্চিমাদের হাতে। তাই পাকিস্তানের বিভক্তি ছিল অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা বুঝে গিয়েছিল, এই স্বাধীনতা তাদের নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে চেতনার অঙ্কুরোদগম হয়েছিল, তা স্বাধীনতার বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছিল একাত্তরে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা।
রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে দেখা হতো করুণার দৃষ্টিতে। অনেকেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। হেনরি কিসিঞ্জার তো বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র বাংলাদেশের ঝুড়িতে আজ উপচেপড়া অর্জন। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। অনেক আগেই বাংলাদেশ সব সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো সূচকে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ যখন বিশ্বের বিস্ময়, পাকিস্তান তখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমরা আর যাই হই, কখনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাই আমার চিরকালীন ভালোবাসা। এই ভালোবাসার সবচেয়ে বড় কারণ, পাকিস্তানের মতো একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের সাথে আমাদের থাকতে হয়নি। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুটে নিয়ে পশ্চিমারা বড় হয়েছে। কিন্তু গত ৫১ বছরে পাকিস্তান ক্রমাগত পিছিয়েছে, আর সবার সব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে। শ্রীলঙ্কার পর এ অঞ্চলে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশটির নাম পাকিস্তান। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি- সব বিবেচনায় বাংলাদেশে এখন পাকিস্তান থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। আমি খালি ভাবি, এখনও যদি আমরা পূর্ব পাকিস্তানই থাকতাম, কী অবস্থা হতো আমাদের। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে বেড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। একসাথে থাকলে এতদিনে বাংলাদেশ হারিয়েই যেতো।
বাংলাদেশের এই অর্জন নিছক রাজনৈতিক কথামালা নয়। এসবই অঙ্কের কথা, পরিসংখ্যানের হিসাব। সে হিসাব অস্বীকার করার সাধ্য কারও নেই। অনেক নাটকীয়তায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া শেহবাজ শরিফও স্বীকার করছেন সেটি। শুধু স্বীকার নয়, আসলে আক্ষেপ করছেন। গত ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের সাথে এক বৈঠকে শেহবাজ শরিফ বলেন, ‘একসময় যাদের পাকিস্তানের বোঝা মনে করা হতো, সেই দেশটি আজ শিল্পোন্নয়নে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’ স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা যখন বেশ ছোট ছিলাম, তখন আমাদের বলা হতো যে এটি (বাংলাদেশ) আমাদের কাঁধের বোঝা। আজ আপনারা সবাই জানেন সেই বোঝা (অর্থনৈতিক উন্নয়নে) কোথায় পৌঁছে গেছে।’
শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নন; সে দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজও বাংলাদেশকেই আজ উন্নয়নের মানদণ্ড মানে। ২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে দেশের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে পাকিস্তানের উন্নয়নে ‘সুইডেন মডেল’ অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়।
সেদিন রাতেই পাকিস্তানের ক্যাপিটাল টিভিতে এক টকশোতে সাংবাদিক জায়গাম খান ক্ষুব্ধকণ্ঠে সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বানিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। তার আকুতিটা এখনও আমার কানে বাজে, ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো’। তবে তিনি এও বলেছিলেন, তিনি নিজেও জানেন এটা অসম্ভব। ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থায় পৌঁছতে পাকিস্তানকে ৯-১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি করতে হবে, যেটা আসলে অসম্ভব। আর পাকিস্তান যখন ‘হাচড়ে-পাচড়ে’ বাংলাদেশের অবস্থানে পৌঁছাবে, তখন বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে আরও ওপরে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আসলে বাংলাদেশ সারাজীবন পাকিস্তানের আক্ষেপের নাম হয়ে থাকবে। যারা ২৩ বছর ধরে নির্যাতন, শোষণ আর বঞ্চনায় আমাদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল; তারা এখন বাংলাদেশের মতো হতে চায়, তবে তারাও জানে এটা এখন আর সম্ভব নয়। জায়গাম খানের সেই অসহায় আকুতি, শেহবাজ শরিফের আক্ষেপ আমার মধ্যে অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি এনে দেয়।
আপনি যদি অন্ধ সরকার বিরোধী হন, আওয়ামী লীগের উন্নয়নও অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ’আমরা পাকিস্তান আমলে আর্থিক ও জীবনযাত্রার দিক থেকে অনেক ভালো ছিলাম। তারপরেও পাকিস্তান সরকার যেহেতু আমার অধিকার ও সম্পদহরণ করতো সে কারণে আমরা যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন তার থেকেও খারাপ অবস্থায় আছি।’ তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা নিছক আওয়ামী বিরোধিতা নয়, এটা আসলে হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা পাকিস্তান প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তানিরা বুঝলেও বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের অনেকেই সেটা বুঝতে চান না। বাংলাদেশে অবশ্য দুই ধরনের আটকেপড়া পাকিস্তানি আছে। কিছু আছে শারীরিকভাবে আটকেপড়া, কিছু আছে মানসিকভাবে আটকেপড়া। শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর এবং সৈয়দপুরের বিভিন্ন ক্যাম্পেই মানবেতর জীবনযাপন করেন। তবে এই সংখ্যাটা অল্প। তবে তাদের বেশিরভাগ যেহেতু একটা নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে, তাই তাদের সহজেই চেনা যায়। কিন্তু শারীরিকভাবে আটকেপড়াদের মতো মানসিকভাবে পাকিস্তানকে নিজের দেশ মনে করা অনেকেও এখন বাংলাদেশে আটকে পড়েছেন। তারা একাত্তর সালে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন। শান্তি কমিটি, আল বদর, আল শামস নানান বাহিনী গড়ে তারা পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেছে।
স্বাধীনতার পর আটকেপড়া পাকিস্তানিদের মতো মানসিকভাবে পাকিস্তানকে নিজের দেশ মনে করা একটা গোষ্ঠীও বাংলাদেশে আটকা পড়ে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এই গোষ্ঠীটি বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ মনে করতে পারেনি। বরং এই ৫৩ বছরে তারা ঝাড়ে-বংশে বেড়েছে। শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক মনে করলেও মানসিকভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের উত্তরসূরিরা এখনও পুরোপুরি বাংলাদেশি হতে পারেনি। বাংলাদেশের এই পাকিস্তানি ধারাটি কিন্তু নতুন নয়। এমনকি ৭০এর নির্বাচনেও এই বাংলাদেশের অনেকে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। শুধু পক্ষে থেকে ক্ষান্ত হয়নি, তারা পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে মিলে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষদের হত্যা করেছে। বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লড়াই শুরু হয়। তখন এই স্বাধীনতাবিরোধীরা ঘাপটি মেরে ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবার মাঠে নামে। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে রাতারাতি বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা হয়।
জয়বাংলা হয়ে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি ধারার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। রাজাকার শিরোমনী গোলাম আযম দেশে ফেরার সুযোগ পায়। স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতাবিরোধী সেই ধারার নেতৃত্ব এখনও বিএনপির হাতেই। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্ব এখন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে, যার পিতা ছিলেন একাত্তরে শান্তি কমিটির নেতা। মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে পায় না।
এটা ঠিক টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মানবিধকার, ভোটাধিকার, দুর্নীতি, অর্থপাচার, গুম, খুনের হাজারটা অভিযোগ করা যাবে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, সেটাও স্বীকার করতে হবে। আপনি যদি অন্ধ সরকার বিরোধী হন, আওয়ামী লীগের উন্নয়নও অস্বীকার করতে পারেন। কিন্তু বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ’আমরা পাকিস্তান আমলে আর্থিক ও জীবনযাত্রার দিক থেকে অনেক ভালো ছিলাম। তারপরেও পাকিস্তান সরকার যেহেতু আমার অধিকার ও সম্পদহরণ করতো সে কারণে আমরা যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন তার থেকেও খারাপ অবস্থায় আছি।’ তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, এটা নিছক আওয়ামী বিরোধিতা নয়, এটা আসলে হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা পাকিস্তান প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও লজ্জা পান। কিন্তু বাংলাদেশের আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সেই চক্ষুলজ্জাটাও নেই। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেন।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন