তপু সরকার হারুন,
দুর্নীতি বাংলাদেশে ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়েছে নানা ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও ধর্মীয়, বেসরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি চরম আকার ধারন করেছেন। দুর্নীতি ও দেশের আর্থিক ক্ষতি জাতীয় উন্নয়নে দুর্নীতির চরম প্রভাব। দুর্নীতি ও জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়া দুর্নীতি ও প্রবৃদ্ধি-দুর্নীতি ও বিনিয়োগে-দুর্নীতি ও মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন-দুর্নীতির প্রভাব। বাংলাদেশে দুর্নীতির ঐতিহাসিক কিছু কারণ দুর্নীতি ও বিনিয়োগে মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে দুর্নীতির ব্যাপকতার হারে বেড়েছে। এ কারণসমূহ- আর্থিক অসচ্ছলতা- উচ্চাভিলাষী জীবনের মোহ- বেকারত্ব- অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা- রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা- অপর্যাপ্ত বেতন ও পারিশ্রমিক - দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধের অভাব।
দুর্নীতির করালগ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত ও অনুজ্জ্বল। বিশেষজ্ঞ মহল দুর্নীতিকে জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমাদের সবাইকে দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, এর জন্য দায়ী কারণ খুঁজতে হবে এবং তা মোকাবিলার উপায় উদ্ভাবনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ। দুর্নীতির সাথে পেশা, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, পদবি প্রভৃতি অপব্যবহার সংশ্লিষ্ট। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলো ঘুষ বা অনুগ্রহ দ্বারা জনকর্তব্য সম্পাদনে একাগ্রতার বিকৃতি বা ধ্বংস।
আবার প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ। কিংবা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কাউকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারী নিজের খেয়ালখুশিমতো সরকারি ক্ষমতা, তার পদমর্যাদার অপব্যবহার করে বা টাকা-পয়সা এবং বস্তুগত ও অন্যবিধ উৎকোচাদির মাধ্যমে অন্যায় কোনো কাজ করে অথবা ন্যায়সঙ্গত কাজ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তার এরূপ কার্যকলাপ দুর্নীতি।
অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে অফিস-আদালতকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে বোঝায়। সাধারণত ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভয়প্রদর্শন, প্রভাব এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণ প্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনকে দুর্নীতি বলা হয়।
আমাদের দেশে জাতীয় উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিভাবে দুর্নীতি বিরাজ করছে।রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মূল চালিকাশক্তি। অথচ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপকহারে দুর্নীতি চলছে। জনগণের সাথে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বরখেলাপ, ক্ষমতায় থাকাকালে নিজ পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে অন্যায়ভাবে নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও নিজ দলীয় কর্মী সমর্থকদের স্বার্থে কাজে লাগানো, তাদেরকে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি বা হাট-বাজারের ইজারা প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স দেয়া, ব্যবসায়ীমহলসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে কমিশন গ্রহণ ও চাঁদা আদায় এবং বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন অন্যায় সুবিধা প্রদান, সরকারি অর্থের অপচয় ও আত্মসাৎসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে এ দেশে স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছেবর্তমানে বাংলাদেশের কোনো সরকারি দপ্তর বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়।
ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকার সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয়ে থাকে।ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, ওজনে কম দেয়া, সরকারি রেশনে কারচুপি করা, কর, শুল্ক, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেখাসহ এ ধরনের অর্থনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলছে।পরীক্ষায় ব্যাপক নকলাকাতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে না।এ দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করেও নানা রকমের দুর্নীতি চলছে। জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা স্বার্থসিদ্ধি, অর্থ উপার্জন বা কাজ ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ভূক্ত বিভিন্ন ধরনের ধর্মব্যবসা, রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোও ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহা-বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এমনই শক্তিশালী যে, দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে।
গত ৩৫ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ পরপর পাঁচ বার বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে দুর্নীতির জন্য। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ এ পাঁচ বছর বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল বহু ত্যাগ-সংগ্রামের পর।
এ দেশে বিগত তিন দশকে আমাদের যা কিছু প্রশংসনীয় অর্জন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জামানত ছাড়াই উন্নয়নমূলক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, ডায়ারিয়া প্রতিরোধী ওরস্যালাইনের আবিষ্কার, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, নারী শিক্ষা ও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের প্রসার ইত্যাদি সবকিছুই যেন ম্লান করে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী আমাদের এই কলঙ্কিত উপস্থাপনের মাধ্যমে। পরপর তিনবার শীর্ষ দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে এই পরিচিতি সারা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
শুধু সরকারি খাতে নয়, বেসরকারি খাতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারি সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাস-বাসন বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশী ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না কর, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া শেয়ার মার্কেট কেলেংকারি ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঋণখেলাফী বর্তমানে বাংলাদেশে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।আস
তপু সরকার হারুন: সাংবাদিক। সাবেক ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন