সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ
বুশনেল একজন মার্কিন, একজন শ্বেতাঙ্গ, একজন অমুসলিম, এমনকি একজন মার্কিন বিমান বাহিনীর কর্মী। এইসব পরিচয় যে মনুষ্যত্ব শেষ করে দেয় না, বরং এই মানুষগুলোও আমাদের লড়াইয়ের সঙ্গী তা মনে করিয়ে দেয়। বুশনেল মনে করিয়ে দেন, শাসক আর শোষক দুইটা শ্রেণি
‘আমার নাম এরন বুশনেল। আমি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য এবং আমি আর কোনোভাবেই গণহত্যার অংশ হতে চাই না। আমি এমন একটি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি যা ভীষন ভয়াবহ, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা নিজের দেশের মাটিতে দখলদারদের যে আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে তার তুলনায় কিছুই না। অথচ আমাদের শাসকশ্রেণি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে— এই ব্যাপারটি স্বাভাবিক।’
এই কথাগুলো বলে প্রথমে একটা বোতল থেকে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢাললেন, এরপর পুরো শরীরে আগুন লাগিয়ে দিলেন। এরপর চিৎকার করে বলতে লাগলেন : ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো! ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো!
বুশনেল ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এক টগবগে তরুণ। আমাদের অনেকের ধারণা মার্কিন মুলুক মানেই একটু কেমনধারা যেন! সারা দিন খালি ভোগের চিন্তা। ফাস্ট ফুড খাবে, নিজের গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়বে না, সারা দিন কেবল ভোগ আর ভোগ করবে। সর্বোপরি এদের কোনো রাজনৈতিক চিন্তা নেই।
আর সে দেশের শাসক তো বলিহারি! গণতন্ত্রের নামে এদেশের সম্পদ লুট করবে, সেদেশে বোমা ফেলবে। কখনো ল্যাটিন আমেরিকায় দেশের পর দেশ লুট করার জন্য স্বৈরশাসক বসাবে কখনো আবার মধ্যপ্রাচ্যে দশকের পর দশক বোমাবাজি করবে তথাকথিত গণতন্ত্র আর মানবতার নামে।
কিন্তু, বুশনেল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন যে দেশের শাসক আর দেশ বা জনগণ এক না। ইতিহাসে এই সত্য হাজার হাজার বার উন্মোচিত হলেও আমরা ভুলে যাই যে দুটো তো এক নাই-ই, বরং যে দেশের শাসক সবচেয়ে বেশি অত্যাচারী, যে দেশের ব্যবস্থা যত বেশি শোষণের, সেখানকার জনতাই এর প্রাথমিক শিকার।
গত শতকে মার্কসিস্ট তাত্ত্বিক গ্রামসি বলেছিলেন, যাদের অঙ্গুলি হেলনে পুতুল নাচ হয় আর যারা পুতুল নেচে জনতাকে শোষণ করে, দুইয়ের ফারাক আছে। লাঠি যার নিয়ন্ত্রণে থাকে, আক্রমণটা তাকে করতে হবে, আমাদের সমস্ত শক্তি যদি আমরা লাঠি ঠেকাতেই খরচ করে ফেলি তবে যারা লাঠি চালায় তারা অগণিত লাঠির সরবরাহ করবে। লাঠির আঘাত থামাতে আমাদের আঘাত করতে হবে মূলে।
গ্রামসির এই তত্ত্ব আরও একধাপ এগিয়ে ব্যাখ্যা দেন উরুগুয়ের বিপ্লবী এদুয়ার্দো গালিয়ানো। তিনি দেখান, দেশে দেশে দখলদারদের যেসব সেনা আক্রমণ করে, মানুষ মারে, এরা একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে, যেসব সেনা যুদ্ধ থেকে ফেরে তারা আর স্বাভাবিক থাকে না। মানুষ মারার যে তীব্র মানসিক চাপ, তা নেওয়া বেশিরভাগেরই সম্ভব হয় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শাসকগোষ্ঠী দুইভাবে লাভবান হয়। যাদের তারা শোষণ করে, তাদেরই একটা অংশকে লাঠিয়াল বানিয়ে হয় পোষ্য না হয় পাগল বানিয়ে ফেলে, আরেক অংশকে তাদের দিয়ে লাঠিপেটা করে। আর শাসকের বশংবদ হয়ে ওঠে মিডিয়া। তারা কোনোভাবেই এই দুইয়ের তফাৎ ঘুচানোর চেষ্টা তো করেই না, উলটো উসকে দেয়।
এই যেমন ফিলিস্তিনের কথাই ধরা যাক। ফিলিস্তিনে সম্প্রতি যে গণহত্যা চলছে, সেই গণহত্যার নির্মমতা অতীতের যে কোনো নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই গণহত্যায় প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শুধু কি তাই! মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নারী ও শিশুদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। নিরস্ত্র, অসহায় মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে বিমান থেকে টনকে টন বোমা ফেলে। দখলদারেরা শুধু দখল না, সব নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। অথচ এসব দেখে পশ্চিমা শাসকরা, যারা আমাদের গণতন্ত্রের সবক দেন, তারা চুপ।
শুধু চুপ বললে ভুল হবে, তারা সক্রিয়ভাবে দখলদারদের সাহায্য করছে। অসহায় মানুষকে সাহায্য করার পথ আটকে দিচ্ছে। আমরা অতীত যুগের অনেক হিংস্র শাসকের কথা শুনি, খুনিদের কথা শুনি, কিন্তু এইরকম ঠাণ্ডা মাথায়, হাজার হাজার মাইল দূরে বসে এইরকম নির্মমতা অকল্পনীয়। আর উনারাই নাকি আবার ‘সভ্য’ মানুষ, সবচেয়ে উন্নত।
সাধারণ মার্কিনিদের জন্য খারাপই লাগে। পুঁজিবাদের চাপে সে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, সেই দেশে সোশ্যাল মোবিলিটি বা কাজ করে নিজের অবস্থা উন্নয়নের সম্ভাবনা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। একে তো তীব্র গতিময়, কঠোর জীবন, এর ওপর চাপানো ভোগবাদ। আর তাতেও না কুলাতে পারে এই ধারণা থেকে মিডিয়া ব্ল্যাকআউট ও প্রোপাগান্ডা।
মার্কসবাদী দার্শনিক আলথুসার বলেছিলেন, রাষ্ট্র তার সমস্ত যন্ত্র যথা শিক্ষাব্যবস্থা, আইন, মিডিয়া এগুলো ব্যবহার করে ছোটবেলা থেকেই নাগরিকদের নিজেদের ছাঁচে গড়ে তোলে। নাগরিক যাতে রাষ্ট্রের বাধ্যগত পুতুল হয় সেই এন্তেজাম করে। আর মিডিয়াতে ছড়ানো হয় নিজেদের জাতকে সেরা ভাবা আর অপরকে ছোট করার প্রোপাগান্ডা। হিটলারের জার্মানি যেমনটা ছিল, তার সঙ্গে মার্কিন মুলুক আর বর্তমান পশিচমের পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমটা ছিল খোলামেলা, পরেরটা অনেক বেশি কৌশলী।
তবে, এই কথাও ঠিক, দোষটা একার পশ্চিমের না। এই সিন্ড্রোম কমবেশি সবার আছে। যে শক্তিহীন, যে শোষিত সেও সুপিরিয়র সিনড্রোমে ভোগে। মুসলমানদের বড় অংশের ধারণা ফিলিস্তিনিরা কেবল মুসলমান বলেই মার খায়। লড়াইটাকে তারা মুসলিম বনাম অমুসলিম বানিয়ে ফেলে। দুনিয়ার সবকিছুকেই ভাবে মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
এই মন্ত্র ছড়িয়ে স্থানীয় শাসকদের লাভ হয়। তারা এই জজবায় জনতাকে ভুলিয়ে রাখে। আমরা যদি আরব বিশ্বের দিকেই তাকাই, তবে দেখব সেখানকার শাসকরা নিজেদের স্বার্থ আর ক্ষমতার জন্য পশ্চিমের তাঁবেদারি করে আর নিজেদের দেশের মানুষকে সবসময় কড়া শাসনে রাখে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে এইসব শাসকের আচরণ কোনো অংশেই পশ্চিমা শাসকদের চেয়ে কম ঘৃণ্য নয়।
অবশ্য ষাটের দশকটা এইরকম ছিল না। তখন পৃথিবী উত্তাল ছিল। ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসত, শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারত, সব শ্রেণির নারীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিল নারীবাদীরা। আর এই জোয়ারকে সাদরে প্রচার করত মিডিয়া। কারণ, মিডিয়া জানত ব্যবসাটা এখানেই।
এমনকি ইউরোপের দেশগুলোও তখন ইসরায়েল প্রশ্নে এতটা একপেশে ছিল না। জার্মানিসহ নানা দেশে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতেন মোটামুটি প্রকাশ্যেই। বৈশ্বিক নেতারাও চাইতেন রাজনৈতিক সমাধান। ফলে, ইয়াসির আরাফাতের মতো মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃত হতেন বীর হিসেবে।
কিন্তু, ইসরায়েলের অস্ত্র আর ইন্টেলিজেন্সের ব্যবসা, মুসলিম বিশ্বের নেতাদের বিপুল লোভ সেই দৃশ্য পালটে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সোভিয়েত ভাঙার পর বিশ্ব পরিস্থিতি। কমিউনিজমকে শত্রু দেখানো মার্কিন শাসকরা এবার বেছে নেয় মুসলিমদের। তাদের জঙ্গি বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা দুনিয়ায় দখল কায়েমের পায়তারায় রত।
বলাই বাহুল্য, মুসলিমদের একটা অংশ এই ফাঁদে পা দেয় এবং নিজেদের এই লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শাসক গোষ্ঠীর মিডিয়া ও অন্যান্য যন্ত্রের সুকৌশলী প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় শাসকদের বিপুল লোভ।
আর পুঁজিবাদের আরও একটা অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়। পশ্চিমের সাদারা এসবের জন্য লক্ষ্যবস্তু বানায় ইমিগ্র্যান্টদের। ছড়িয়ে পরে বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষ। এর প্রভাব ভাইরাসের মতো আক্রান্ত করে গোটা দুনিয়াকে।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়া মানুষ, শাসকের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ দিশেহারা হয়ে থাকে। উত্তেজিত হয়ে থাকে। এই উত্তেজনা কাজে লাগিয়ে তাদের মধ্যে আরও বেশি বিভেদ তৈরি করা সহজ হয়। মানে, যেই শাসকশ্রেণির ব্যর্থতায় মন্দা এলো সেই শ্রেণিই এর থেকে উৎসারিত উত্তেজনা ব্যবহার করে জনতার মধ্যে হিংসার বিষ ছড়িয়ে দিল।
লোকরঞ্জনবাদের সঙ্গে শাসকের তুনে যুক্ত হলো আধুনিক প্রযুক্তি। সারভেইলান্স ক্যাপিটালিজমের যুগে প্রতিটা মানুষের প্রাইভেট লাইফ নিয়ন্ত্রিত হলো। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হলো যাতে মানুষ ওতেই বুঁদ হয়ে থাকে। সেখানে প্রতিবাদ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করার আত্মরতিতে ভোগে। সামষ্টিক প্রতিরোধ দূরের কথা, প্রতিবাদটাও নষ্ট করে ফেলা যায়।
কিন্তু, এতসব বিপুল বাধা, এইরকম অবিশ্বাস্য সব কঠোরতার ফাঁক গলে একজন এরন বুশনেল প্রমিথিউস হয়ে ওঠেন। দেবতাদের কঠোর পাহারা থেকে আগুন চুরি করে এনে আমাদের আরেকবার উসকে দেন।
বুশনেল একজন মার্কিন, একজন শ্বেতাঙ্গ, একজন অমুসলিম, এমনকি একজন মার্কিন বিমান বাহিনীর কর্মী। এইসব পরিচয় যে মনুষ্যত্ব শেষ করে দেয় না, বরং এই মানুষগুলোও আমাদের লড়াইয়ের সঙ্গী তা মনে করিয়ে দেয়। বুশনেল মনে করিয়ে দেন, শাসক আর শোষক দুইটা শ্রেণি। হিন্দুত্ববাদী ভারতে যে কৃষকরা লড়াই করছেন অধিকার আদায়ে, আমাজনের জঙ্গলে যে আদিবাসীরা লড়াই করছেন প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায়, দেশে দেশে যেসব তরুণ লড়াই করছেন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে, এরা জাতবর্ণ নির্বিশেষে আমাদের লড়াইয়ের সঙ্গী।
ফিলিস্তিন আমাদের কারবালা, আমাদের কুরুক্ষেত্র।
এরন বুশনেল আমাদের আগুনের পরশমণি।
লেখক : সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন