মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রতি নতুন করে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। চিঠির বিষয়বস্তুর মাধ্যমে একটি আশাবাদী বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং মানবিক সহায়তার সম্পর্ক জোরদার করবে। একই চিঠিতে মানবিক সহায়তার বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যা এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে রাখবে। বাংলাদেশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার নতুন পর্যায় শুরু করতে চলেছে, এই চিঠিটি কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, বিশেষ করে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটে।
বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে, অর্থনৈতিক লক্ষ্য ও নিরাপত্তা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অংশগ্রহণ না থাকার কথা তুলে ধরে মার্কিন প্রশাসন এর আগে নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার গুজব ছড়ানো হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠির মাধ্যমে এই উদ্বেগগুলো খারিজ করে দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়ে আরো আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে লেখা বাইডেনের চিঠি শুধু কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও গভীর প্রভাব ফেলবে। কারণ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে নতুন সরকার গঠিত হলেও বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি ক্রমাগতভাবে সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, বিক্ষোভের আয়োজন করছে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এই চিঠি তাদের সে উদ্যমে কিছুটা হলেও ভাটার টান সৃষ্টি করবে। কারণ এই চিঠির মাধ্যমে মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সরকারকে শুধু বৈধতা প্রদান করেনি, আস্থায়ও নিয়েছে।
ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠি সব বিরোধীপক্ষের নির্বাচনসংক্রান্ত কল্পকাহিনি প্রচারের প্রচেষ্টাকেও বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
দেশ ও দেশের বাইরে থাকা এক শ্রেণির শিক্ষাবিদ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত, যাঁরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মর্মে সব সময় সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত রয়েছেন, এই চিঠি তাঁদেরও আশাহত করবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি তাঁরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি মর্মে বক্তব্য প্রদান করে চলেছেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মার্কিন প্রশাসন নির্বাচনের ফল মেনে নেবে না এবং বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করবে।
ফলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠি তাঁদের হতবাক করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব বুদ্ধিজীবী সব সময় সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত রয়েছেন, বিরোধী রাজনৈতিক জোট আহৃত হরতাল, অবরোধ এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তাঁদের কখনোই সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। এমনকি বিরোধীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যেসব সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছে এবং যারা আগুনে পোড়ার জ্বালা নিয়ে বেঁচে আছে, তাদের প্রতি কখনো কোনো সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। ফলে এই সব বিশিষ্টজনের পক্ষপাতদুষ্ট সমালোচনার অবসান হবে এই পত্রের মাধ্যমে।
বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অর্থনৈতিক পরিণতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে সহায়তা করার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতিশ্রুতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই প্রতিশ্রুতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সরকারকে সহায়তা করবে।
এখন একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, কেন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের প্রতি তার কৌশল পরিবর্তন করল? বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিক্রিয়া। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাবণ্টনের ক্রমাগত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন দেশ বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বকে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গমস্থলে একটি কৌশলগত অবস্থান দখল করে আছে, যা এটিকে আঞ্চলিক বাণিজ্য পথ এবং সামুদ্রিক সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র করে তুলেছে।
তা ছাড়া বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেশটিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং দ্রুত উন্নয়নশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য একটি উদীয়মান বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের প্রভাব জোরদার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে একটি অপরিহার্য মিত্র হিসেবে ভাবছে।
এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল স্বীকার করা এবং নবগঠিত সরকারের সঙ্গে তার সংযোগ বাড়ানো ছাড়া খুব কম বিকল্প ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে এই অঞ্চলে তার কৌশলগত স্বার্থ বাড়াতে পারবে, যার মধ্যে রয়েছে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, আঞ্চলিক ঝুঁকি হ্রাস এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।
এখানে উল্লেখ্য যে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে শি চিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন, ঋষি সুনাক এবং নরেন্দ্র মোদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতারা অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই অভিনন্দন তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পরিচয় বহন করে। এই স্বীকৃতি একদিকে যেমন দেশের কূটনৈতিক পরিপক্কতার প্রতিনিধিত্ব করবে, ঠিক অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করবে।
পরিশেষে বলা যায়, শেখ হাসিনাকে লেখা বাইডেনের চিঠির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। এই চিঠি কেবল বাংলাদেশের ওপর মার্কিন সরকারের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞাগুলো নিয়ে উদ্বেগকে প্রশমিত করেনি, বরং বিরোধী দল এবং সমালোচনাকারী চিন্তাবিদদেরও একটি ধাক্কা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্কের বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে এবং বর্তমান প্রশাসনের বৈধতা সম্পর্কে যেকোনো প্রশ্ন দূর করতে সহায়তা করবে। যেহেতু উভয় দেশই তাদের সম্পর্কের এই ‘পরবর্তী অধ্যায়’ শুরু করতে চলেছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠিটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের অংশীদারির জন্য একটি আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, যা বাংলাদেশের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে।
ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে
লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন