মনোজ দে
শীত শুরুর আগের সময়টাতে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের অন্যতম শিরোনাম থাকে দিল্লির দূষণ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি দিল্লি। ধান ওঠার পর পাঞ্জাবের কৃষকেরা নাড়া পোড়ান তাঁদের খেতে। সেই ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে দিল্লিতে প্রবেশ করে। সেখানকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধুলা, সিসা, ভারী কণা কিংবা তেলচালিত গাড়ির পোড়া কার্বন তাতে মিশে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। দূষণের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষার জন্য এ সময়টাতে দিল্লি সরকার রেড অ্যালার্ট জারি করে।মারাত্মক দূষিত বাতাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন শিশু আর বৃদ্ধরা। ফলে শিশুদের আপাত সুরক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ঘরের বাইরে বেরোতে বারণ করা হয়। সরকারি কর্মীদের সশরীর অফিস আসা বন্ধ করে হোম অফিস চালু করা হয়। জোড়-বিজোড় নম্বরের গাড়ি পালা করে বন্ধ রাখা হয়। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে অক্সিজেন ক্যাফে চালুর সংবাদও পাওয়া যায়।
মোগলদের সময়ে দিল্লি গোটা ভারতবর্ষের রাজধানী। তখন যোগাযোগব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণেই দিল্লি পৌঁছানো খুব সহজ ছিল না। সে কারণেই হয়তো ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’ বা দিল্লি এখনো ঢের দূর প্রবাদটির প্রচলন হয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে শীত শুরুর এই সময়টাতে ঢাকা, দিল্লির খুব কাছে চলে আসে। দূষণে কে কাকে পেছনে ফেলবে, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। ১৪ নভেম্বর সকালে বায়ুদূষণে দিল্লিকে হারিয়ে প্রথম স্থান দখল করে ফেলে ঢাকা। কয়েক ঘণ্টা পর অবশ্য সেই জায়গা দখল করে নেয় দিল্লি। এ তথ্য সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের।
কোনো কোনো প্রথম হওয়া শুধু গ্লানির নয়, চরম ভোগান্তি আর শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে বায়ু, পানি, আর্সেনিক. পরিবেশদূষণে প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ, বিশেষ করে ঢাকা। আর একটি দূষণেও আমরা সম্মুখ সারিতে আছি বছরের পর বছর ধরে। সেটা মানসিক দূষণ, কেতাবি বাংলায় যাকে দুর্নীতি বলি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর দূষণ প্রকৃতপক্ষেই মানিক জোড়। এসব কারণে বিশ্বের বাস অযোগ্য নগরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান সপ্তম।
ঢাকার ঘরে ঘরে এখন কাশির দমকে কান পাতা দায়। সড়ক-অলিগলি সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত মানুষে পূর্ণ। শিশু, দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ কিংবা বয়স্ক নাগরিকেরা হরেদরে শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। শক্তসামর্থ্যরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ১৪ নভেম্বর যেদিন বায়ুদূষণে প্রথম হয়েছিল, সেদিন ঢাকার বায়ু মান সূচক ছিল ১৯৫। বাতাসের মান অনুযায়ী অস্বাস্থ্যকর। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্যসতর্কতাসহ জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট এ বছরের মে মাসে বিশ্বে দূষণজনিত মৃত্যুর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞান সাময়িকীটি জানিয়েছে, বায়ু, পানি, মাটি ও রাসায়নিক দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। ২৩ লাখ মৃত্যু নিয়ে শীর্ষ স্থানে আছে ভারত। তবে এককভাবে বায়ুদূষণে মৃত্যুর বিচারে ভারতের পরেই বাংলাদেশের স্থান। এরপরেই আছে নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা। দূষণ ও দূষণজনিত মৃত্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ও এখানকার নগরগুলো কেন শীর্ষে থাকছে, তার পেছনে কী কী কারণ আছে, তা বের করা জরুরি। কিন্তু এতে প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষ বিচ্ছিন্ন একরৈখিক উন্নয়ন ধারণার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখক ও আন্দোলনকর্মী অরুন্ধতী রায় কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে এ প্রবণতাকে বলেছিলেন, সব দেশ থেকে প্রাণরস নিংড়ে নিয়ে একটা বা দুটো নগরে সমৃদ্ধি গড়ে তোলা।
সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশেও একরৈখিক উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রে ঢাকা। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। স্বাধীনতার পর ৫২ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশের একমাত্র মহানগর ঢাকা আজও নির্মাণাধীন। অবকাঠামো, স্থাপনা, বহুতল ভবন, সড়ক, ড্রেনেজব্যবস্থা না অন্য কিছু ৫০ বা ১০০ বছরের পরিকল্পনা করে নির্মাণ হয় না। ভাঙা ও গড়ার কাজ একসঙ্গেই চলছে। ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে প্রায় ডজনখানেক সংস্থা জড়িত। কেন্দ্রীয় কোনো সমন্বয় না থাকায় ‘আমাদের রাজার রাজত্বে, আমরা সবাই রাজা’। যে সড়ক তিন মাস আগে ওয়াসা খুঁড়ল, সেই সড়ক আবার তিন মাস পরে ডেসা খোঁড়ে। কোনো নিয়মের ব্যতিক্রম ছাড়াই এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে মেগা প্রকল্প। মেয়াদ বাড়ে, প্রকল্প ব্যয় বাড়ে। এসব অবকাঠামো উন্নয়নে কিছু মানুষ আলাদিনের চেরাগের দৈত্য হাতে পেয়ে যায়। আবার নীতিনির্ধারকদের আকাঙ্ক্ষা পূরণেও আইকনিক স্থাপনা ভেঙে আধুনিক স্থাপনাও তৈরি হতে থাকে।
ঢাকার ঘরে ঘরে এখন কাশির দমকে কান পাতা দায়। সড়ক-অলিগলি সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত মানুষে পূর্ণ। শিশু, দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ কিংবা বয়স্ক নাগরিকেরা হরেদরে শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। শক্তসামর্থ্যরাও রেহাই পাচ্ছেন না। ১৪ নভেম্বর যেদিন বায়ুদূষণে প্রথম হয়েছিল, সেদিন ঢাকার বায়ু মান সূচক ছিল ১৯৫। বাতাসের মান অনুযায়ী অস্বাস্থ্যকর। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্যসতর্কতাসহ জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। ছুটির দিন বাদে ঢাকার বাতাস গত কয়েক দিনে দূষণের সূচক কমবেশি একই রকম।
এ ধরনের বাতাসে বাইরে বের হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু পরিবেশদূষণ এখনো আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে লিখিত নীতির মতো বিষয়। এটা কমিয়ে আনার কোনো পদক্ষেপ কোথাও কারও ভেতরে নেই। কোভিডের সময় মাস্ক পরার অভ্যাস নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সালের সঙ্গে কথা হয়েছিল। আলাপের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন এখানে যে পরিমাণ দূষণ, তাতে ঘরের বাইরে বের হলে মাস্ক না পরে বের হওয়াটা অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধটা কি ভুক্তভোগী নাগরিকদের? বাতাসে ভয়াবহ মাত্রার দূষণ অথচ সরকার, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের বিকার নেই কেন?
আরও পড়ুন
বাংলার জল, বাংলার বায়ু কেড়ে নিচ্ছে মানুষের আয়ু
বাংলার জল, বাংলার বায়ু কেড়ে নিচ্ছে মানুষের আয়ু
ঢাকার বাতাস ভয়াবহ দূষণের জন্য অন্যতম কারণ চারপাশের ইটভাটা। উচ্চ আদালত কয়েক দিন আগে সারা দেশে অবৈধ ইটের ভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগেও উচ্চ আদালত সড়কে পানি ছিটানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এসব পদক্ষেপ হয়তো দিঘির পানিতে শৈবালের দেওয়া কয়েক ফোঁটা শিশিরের মতো। তাতে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি নাও হতে পারে। কিন্তু নাগরিকদের করের টাকায় চালু থাকা সরকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা কিংবা জনপ্রতিনিধিরা যে আছেন তা টের পাওয়া যেত। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন কে করবে? শুধু একবার চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করুন, দূষণে বছরে দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মহামারি আর কি? আমাদের একচোখা উন্নয়ন ভাবনা থেকে কবে বেরিয়ে আসতে পারব আমরা?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন