ওরা সমাজকে বলল- তোমরা যত বাধাই দাও, আমরা সেই বাধা টপকাতে পারি। সাফল্যের কাছাকাছি যেতে পারি। সাফল্যকে ছুঁয়ে দেখতে পারি। মানুষকে দেখাতে পারি আমরা শুধু দারিদ্র্য-দুঃখ-যন্ত্রণা উপেক্ষা-অবজ্ঞা সইতে পারি না। ওগুলোকে সঙ্গী করে দেশের জন্য সাফল্যও বয়ে আনতে পারি!
ওরা রাষ্ট্রকে বলল- আমরা আমাদেরটুকু করেছি। রাষ্ট্র-সরকার কী তাদেরটুকু করবে? রাষ্ট্রের পতাকা ওরা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নেপালে। সেই পতাকা উড়িয়ে এলো সেখানে। চ্যাম্পিয়নের পতাকা উড়েছে কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে। সৌজন্যে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্যরা।
ওরা সরকারকে কী বলবেন? না- কিছুই হয়তো বলবেন না। হয়তো বলবেন, আমাদের যা বলার ছিল আমরা বলেছি। ফুটবল পায়ে বলেছি। সানজিদা আমাদের হয়ে যা বলেছিলেন, আমরা সবাই মিলে তার কথার দাম দিয়েছি। তিনি তো বলেই রেখেছেন, খোলা বাসে ট্রফি হাতে শহর না ঘুরলেও চলবে তাদের। এই কথাটা অভিমানের। অভিমান তারা করতেই পারেন। যে দেশ পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালে আটকানো, সেখানে নারীদের ফুটবল-ক্রিকেট-হকি খেলাকে গুরুত্ব দেন কে! যে দেশে ক্রিকেটে একটা দ্বিপাক্ষিক সিরিজের ম্যাচ জিতলে ক্রিকেটারদের জন্য গাড়ি-বাড়ির ঘোষণা চলে আসে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবর্ধনার আয়োজন চলে, সেখানে প্রথম এশিয়া কাপজয়ী নারী ক্রিকেটাররা কী পেয়েছেন সেই ইতিহাসটা হয়তো অজানা নয়, সাবিনা-সানজিদাদের। তাই তারা প্রত্যাশাকে ডানা মেলতে দেননি। কিন্তু হতাশায় ডুবে যাননি। তাই ওরকম আশার কথা বলার দুঃসাহস দেখাতে পারেন ফাইনালের আগে। ‘যারা আমাদের মাঠের সবুজ ঘাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, ট্রফি জিততে চাই তাদের জন্য...।’ ওরা ট্রফি জিততে চেয়েছিলেন এ দেশের আঠারো কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের জন্য। দেশের মানুষের স্বপ্ন তারা পূরণ করেছেন। প্রতিদানে মানুষ হয়তো শুধু ভালোবাসাই দিতে পারবেন।
ওরা আগামী প্রজন্মের কাছে বলতে চেয়েছেন- জাতীয় দলের জার্সির স্বপ্ন দেখো। কিন্তু ওটা গায়ে জড়াতে অনেক টিপ্পনি সহ্য করতে হবে। অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হবে। তোমাদের পথটা অনেক বন্ধুর। আমরা কিছুটা হলেও মসৃণ করে দেওয়ার চেষ্টা করে গেলাম। বাকি দায়িত্বটা তোমাদের। আমরা হয়তো এই সাফল্যের পরও বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাব। কারণ বাঙালির স্মৃতিশক্তি বড্ড দুর্বল! তোমরা নারী ফুটবলের এই সাফল্যের রঙ মশালটা জ্বালিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেও। ওরা হয়তো বলতে চেয়েছেন, আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলাম। তোমাদের জন্য রেখে গেলাম, এশিয়া জয়ের স্বপ্ন। বিশ্বকাপে প্রবেশের সীমানা!
এসব কিছুকে মনে হতে পারে বায়বীয় কথাবার্তা। কিন্তু সাফে নারী ফুটবলারদের সাফল্য, তাদের চ্যাম্পিয়নশিপ জয় সেটা কোনো স্বপ্ন নয়। বাস্তবতা। যে বাস্তবতার পেছনে রয়েছে আরও রূঢ় বাস্তবতা। আরও মর্মস্পর্শী, মর্মান্তিক অজানা গল্প। অভাব-অনাটন-দারিদ্র্য-সমাজের রক্তচক্ষু কত কিছু সাপের মতো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে যায় এই অদম্য নারীদের থামিয়ে দিতে। কিন্তু ওরা থেমে যাননি। ওদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে আমলাতন্ত্রকে উঠতে-বসতে গালাগালি করার অনেকের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানেও দু-একজন মানুষ আছেন যারা পিছিয়ে থাকা এই মেয়েগুলোকে সামনের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছেন। অনেক কিছু করেছেন।
সানজিদা খাতুনের যে ফেসবুক স্ট্যাটাস গোটা দেশের মানুষকেই নাড়া দিয়েছে, জানিয়ে দিয়েছে এ দেশের নারী ফুটবলারদের উঠে আসার গল্প। চোয়াল চেপে লড়াই করার প্রতিজ্ঞার কথা। সাফল্যের জন্য মাঠে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এ রকম আবেগভরা, হৃদয়ছোঁয়া, চোখ ঝাপসা করা স্ট্যাটাস মানুষকে নাড়া দেবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ফেসবুকের সৌজন্যেই করোনা-পরবর্তী নিউনরমাল লাইভ শুরু হতেই খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ বিশ্বাসের একটা স্ট্যাটাস দেখে একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। ভদ্রলোককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু সেদিনের ওই ছবিসহ তার স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়েছিল, যাক আমলারাও মানুষ। এমনো কেউ কেউ আছেন যারা ফাইলে চোখ আটকে টেবিলের উল্টোদিকে বসা লোকটার দিকে তাকান না। তাদের চোখের দৃষ্টি সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপরও পড়ে। তাই তার জেলার কয়েকজন নারী ফুটবলারকে কেডস, প্র্যাকটিস জার্সি, টি-শার্ট কিনে দিতে নিজেই নিয়ে গিয়েছিলেন দোকানে! তার মানবিক মূল্যবোধ যদি আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় বন্দি হয়ে যেত, তা হলে মানবতার ডাক শুনতে পেতেন না। মানবিকতা-পরার্থতা, তার অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তোলে বলেই তিনি নিজে পাহাড়ের ওই ছোট শহরের জুতার দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন কন্যাসম ওই নারী ফুটবলারদের। নিজে কিনে দিয়েছেন খেলার সরঞ্জাম। পিয়ন-চাপরাসির অভাব ছিল না। থাকার কথা নয়। নিজের বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয় কিছু আমলাকে তো দেখার সুযোগ হয়েছে। কখনো পেশাগত কারণে। কখনো আত্মীয়তার সুযোগে। কিন্তু যে ভদ্রলোককে দেখিনি, কথা হয়নি, নারী ফুটবলারদের সাফল্য নিয়ে লিখতে বসে তার জন্যই কিছু শব্দ খরচ করতে হলো! কারণ তার জেলার কয়েকজন মেয়ে আছেন এই সাফজয়ী দলে। তারা কী বলবেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি এবং জেলা প্রশাসককে! হয়তো বলবেন, ‘স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা।’ হ্যাঁ, কৃতজ্ঞতা ওরা জানাবেন। ওটা ভদ্রলোকের প্র্যাপ্য। কিন্তু রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা হিসেবে আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। উদার-মানবিক একজন কর্মকর্তার পরিচয় দিয়েছেন। এ রকম অনেকের ছোট ছোট অবদানে আমাদের আজকের এই সাফল্য। ফুটবল ফেডারেশন একাই সব করে দেবে বা দিতে পারবে এটা ভাবা ঠিক নয়।
অনেক কিছু না থাকার পরও এ দেশের নারীরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হলো। কম কথা নয়। এ দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষের যে আবেগ, অবকাঠামো-পরিকাঠামো তার ধারেকাছেও যায়নি! নারী ফুটবল তো আরও উপেক্ষিত। এ দেশে পুরুষ ফুটবল কেন, পুরুষরা যে কোনো খেলায় গোলন্দাজ বিপ্লব। সেখানে নারীরা হলো বিপন্নতা। সেই বিপন্নতা কাটানোর চেষ্টা তারা করছেন। নারী ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপ জিতেছেন। পুরুষরা বারবার ব্যর্থতার মহাকাব্য রচনা করেছেন। তবু মাতামাতি-নাচানাচি তো সেই পুরুষদের নিয়েই। অবশ্য একই চেহারা গোটা বিশ্বে। তবে অনেক কিছু পাল্টাতে শুরু করেছে। সেই হাওয়া বদলের পালা বাংলাদেশের নারী ফুটবলেও। মেয়েরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই নারী দলটাকে যিনি প্রায় কোলে-পিঠে করে গড়ে তুলেছেন, সেই কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন এক যুগ ধরে দলটাকে কোচিং করালেও মনে হয় সাফল্যকাব্য এক উপেক্ষিত নায়ক! তবে তিনি একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি কী পেলাম, আমাকে কে কী বললেন তাতে আমি কিছু মনে করি না। আমি আমার কাজটা করে যেতে চাই।’ যে মেয়েগুলো বাংলাদেশ ফুটবলে নতুন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাল, তাদের নিয়েও আশাবাদী ছিলেন ছোটন। ডলার নয়, টাকায় কিছু মাস মাইনে পাওয়া ভদ্রলোক বারবার বলেছেন, ‘ওদের বোঝাতে চেয়েছিলাম ওরা ভালো খেলে। আরও ভালো খেলতে পারে।’ কিন্তু এই কথাগুলো দেশের ফুটবলকর্তা, প্রচারমাধ্যম, সাধারণ মানুষ সবাইকে বুঝতে হবে।
এখন সময় এসেছে শুভেচ্ছা, সহায়তা, সমর্থন নিয়ে নারী ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ানোর। সহযোগিতা, সমর্থন, প্রশিক্ষণ পেলে ওরা পারবে। এই আস্থাটুকু ওদের ওপর রাখতেই পারি আমরা। লেখাটা শেষ করতে গিয়ে সুনীলের কবিতার কথাই মনে পড়ে যায়। ‘কেউ কথা রাখেনি’ যে সমাজে কথা রাখার মানুষের ভীষণ অভাব, সেখানে আমাদের নারী ফুটবলাররা কথা রাখলেন। মস্তিষ্ক-হৃদয়-আবেগ মিলে মন বলছে, ওরা পারবে। আমাদের ফুটবলের অসাফল্যের ছায়া কিছুটা ছোট হলো এই নারীদের জন্য। ওদের সাফ জয়ের সাফল্য চোখে লেগে আছে। থাকবে হয়তো আরও অনেকদিন। যতক্ষণ না এর চেয়ে বড় সাফল্যের কোনো গভীর মুহূর্ত আমাদের সামনে হাজির না হচ্ছে।
তবে যারা সাফ জিতে এলেন, তাদের সব কথা কান পেতে শুনতে চাই। আর একটা কথাই বলতে চাই। অতীতে বাস করতে নেই। প্রাপ্তির কোনো সীমানা নেই। যা পাওয়া গেছে, সেটা সঙ্গে নিয়ে আবার নতুন কিছু পাওয়ার আশায় ঝাঁপাতে হবে।
অঘোর মন্ডল : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন