অলিউল্লাহ নোমান
বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিংয়ের কবলে দিশেহারা বিদ্যুতের গ্রাহকরা। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের বিশাল ঘাটতির কথা স্বীকার করছেন ফ্যাসিবাদি সরকারের মন্ত্রীরাও। এতদিন বিদ্যুৎ উন্নয়নের ডামাডোল শোনা গিয়েছে। গত ২১ মার্চ ফ্যাসিবাদি সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত অহংকারের সাথেই ঘোষণা করেছিলেন দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি সক্ষমতা রয়েছে।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্যকে সাপোর্ট করতে এতদিন বিদ্যুৎ নিয়ে দালাল মিডিয়া এবং দালাল বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসার অন্ত ছিল না। কিন্তু বিদ্যুতের এই উন্নয়নের বেলুন ফুটো হয়ে এখন চুপসে যাচ্ছে। তারাও বলতে শুরু করেছেন বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা। চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদনের ঘোষণা দেয়ার চার মাসের মাথায় বিদ্যুতে মিতব্যয়ী হওয়ার সবক দিচ্ছেন সরকারের মন্ত্রীরা। খোদ শেখ হাসিনাও ৫ জুলাই মঙ্গলবার বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন।
তবে একটি বিষয় দালাল মিডিয়া সুপরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎখাতে লুটপাটের বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। লুটপাট শুরুর আগেই ইনডেমনিটি দেয়া হয় আইন তৈরি করে। এখন বিদ্যুৎ নিয়ে যতই সমালোচনা করতে চান, সেটা করা যাবে। সঙ্কটের কথা বলা যাবে। কিন্তু দেশের কোন আদালতে এই খাতের লুটপাট নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিদ্যুৎখাতে দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে লুটপাটের বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই কুইক রেন্টালের নামে কুইক লুটপাট করতে বিদ্যুৎখাতকেই উপযুক্ত জায়গা মনে করেছিলেন। সুতরাং কুইক লুটপাটেপর পর যাতে কেউ তাঁকে বিচারের আওতায় না আনতে পারেন সেজন্য আইন তৈরি করে আগেই ইনডেমনিটি দেওয়া হয়। জেনে বোঝেই এই ইনডেমনিটি আইন করেছিলেন শেখ হাসিনা।
২০১০ সালে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকারের তৈরি করা বিদ্যুৎখাতে ইনডেমনিটি আইনটির শিরোনাম বেশ চমৎকার। আইনটির শিরোনাম-“বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)-২০১০”। শিরোনাম দেখলে আপনি যে কেউ মনে করবে, দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য এই আইন। আইনের শিরোনামে বলা হয়েছে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। কত সুন্দর কথা। আইনটির ভেতরে যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে সেটা এড়িয়ে গেছেন আওয়ামী দালালরা। এমনকি বিরোধী দলও এনিয়ে কোন কথা বলতে শোনা যায়নি কখনো।
শেখ হাসিনার তৈরি এই অইনটির ভেতরে একটি ধারা সংযোজন করা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে গৃহীত কোন কাজের বিষয়ে দেশের কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এখন সমালোচনা করতে চান, করেন। গালি দিতে চান, দেন। মনে করতে পারেন ভবিষ্যতে ক্ষমতা থেকে গেলে দেখে নিবেন। সেটা ভাবতে পারেন। কিন্তু আইনটি এমনভাবে তৈরি করে শেখ হাসিনা লুটপাট চালিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতেও এনিয়ে তাঁকে আদালতের মুখোমুখি হতে না হয়।
এই আইন তৈরির পরই শুরু হয় কুইক রেন্টালের নামে কুইক লুটপাটের ধুমধাম আয়োজন। আওয়ামী লীগে চিহ্নিত কিছু ব্যবসায়ী কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদিত অনেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেও রাষ্ট্রীয় তহবিলের শত শত কোটি টাকা নিয়েছেন। কারণ, তাদের কেন্দ্রে উৎপাদন না থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ নামে একটা শর্তের আওতায় টাকা দিতে হয় রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। এই লুটপাটের বিষয়ে দালাল মিডিয়া ও আওয়ামী দালাল কথিত বুদ্ধিজীবীরা নীরব। বরং ক্ষেত্রমত তাদের পিতার কন্যাকে বাহবা দিতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় দালাল মিডিয়া ও দালাল বুদ্ধিজীবীদের।
আইনটি তৈরির সময় বিদ্যুতে কুইক লুটপাটের মেয়াদ দেওয়া হয়েছিল ১১ বছর। এই ১১ বছরের লুটপাটে খায়েশ মেটেনি তাদের। তাই আরো যাতে নির্বিঘ্নে লুটপাট চালানো যায় সেই ব্যবস্থা করলেন। তৃতীয়বার ক্ষমতা ধরে রেখে ২০২১ সালে আইনের সংশোধনী আনা হয়। কুইক লুটপাটের মেয়াদ বাড়িয়ে ১১ বছরের জায়গায় ১৬ বছর করা হল। প্রথমে ১১ বছর করা হয়েছিল তাদের ক্ষমতার দুই টার্ম হিসাব করে। তৃতীয় টার্মেও যখন নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব হয়, তখন লুটপাটের ইনডেমনিটির মেয়াদও বাড়ানো হয়। বর্তমানে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। এই ইনডেমনিটির বাড়তি মেয়াদও তাঁর তৃতীয় মেয়াদ পার হওয়ার কিছুদিন পর শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাঁর ক্ষমতার মেয়াদে বিদ্যুতে যতই দুর্নীতি, লুটপাট হউক এনিয়ে কেউ কোন আদালতে যেতে পারবে না।
এই আইনটির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা নিম্নরূপ-
ধারা - ৯
এই আইনের অধীন কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।
ধারা - ১০
এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত, বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্যেও জন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোন প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।
ধারা - ১৪
এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই।
১৪ নম্বর ধারাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দাবী রাখে। এই ধরায় বলা হয়েছে, ইনডেমনিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তাদের লুটপাটের সময়টা বিবেচনা হবে এমনভাবে, যেন আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় নাই। অর্থাৎ ইনডেমনিটির আওতায় থাকা ১৬ বছরের মেয়াদটি অনাদিকাল পর্যন্ত দায়মুক্ত থাকবে।
বেশি দিন আগের কথা নয়। মাত্র সাড়ে চার মাস আগে ২১ মার্চ শেখ হাসিনা পটুয়াখালীতে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খবর পরিবেশন করে ইন্ডিয়াপন্থি প্রথম আলো শিরোনাম করেছিল-‘দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী’। খবরটিতে বলা হয়-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বৃহত্তম ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পর দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে গেলে সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। গত ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। প্রশ্ন হচ্ছে, দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের নামে ইনডেমনিটি দিয়ে কুইক রেন্টাল, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, এমন উন্নয়নের গল্পের মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ে মানুষের সীমাহীন ভোগান্তি কেন?
লেখক: সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন