বৈশ্বিক শাসনপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উদীয়মান অর্থনীতির জোট হিসেবে ব্রিকস সদস্য দেশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে সহযোগী থেকে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্রিকসের সামষ্টিক দর-কষাকষির ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই বছরের ব্রিকস সম্মেলনে দুটি বৈশ্বিক প্রবণতা বিশেষভাবে মনোযোগ কাড়ে। প্রথমত, এ বছর পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো একটি নতুন একচেটিয়া বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে।
তাদের উদ্দেশ্য হলো, জি-২০-কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, ব্রিকসকে বাদ দেওয়া এবং পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন রূপ দেওয়া। ফলে ব্রিকস সদস্যরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, চলমান ইউক্রেন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সংঘাতের অংশ হিসেবে রাশিয়া ছাড়া ব্রিকসের অন্য চারটি সদস্য ব্রাজিল, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা—কেউই রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কথা শোনেনি। এর ইঙ্গিতটা হলো, ব্রিকস দেশগুলো মূল আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তি তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ব্রিকস অর্থনীতিগুলো বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে আংশিক বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ভারতের অবস্থান। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মার্কিন চাপ সামলে রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিকস দেশগুলো কি অর্থনৈতিক সমস্যা ও রাজনৈতিক মেরুকরণের মতো চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রমের পাশাপাশি বিশ্বায়ন ও বৈশ্বিক শাসনপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে পারবে? জবাবটি হলো ‘হ্যাঁ’। ব্রিকস দেশগুলোর মৌলিক স্বার্থ, মূল্যবোধ ও আইন-কানুন মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই মিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় তাদের এমন এক অবস্থানের কথা তুলে ধরে, যার অর্থ হলো শান্তি, উন্নয়ন, সহযোগিতা ও সুযোগ সবার জন্য সমান। এ জন্যই তাদের বর্তমান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো আংশিক, অস্থায়ী ও অতিক্রমযোগ্য।
ব্রিকস দেশগুলোর সাধারণ আকাঙ্ক্ষা হলো বর্তমান বৈশ্বিক শাসনপ্রক্রিয়ায় অযৌক্তিক স্থিতাবস্থার পরিবর্তন করা। এর মধ্যে ইতিহাসের রেখে যাওয়া ঔপনিবেশিক উপাদান এবং বাস্তবে বিদ্যমান আধিপত্যবাদী ব্যাপারগুলোও আছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থায় ব্রিকসের দেশগুলোর অংশগ্রহণের মূল ঝোঁকটাই হলো পুরনো শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সংস্কার চালিয়ে যাওয়া এবং নতুন বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা। রুদ্ধ ও পুরনো ধাঁচের জি-৭ ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে ব্রিকস দেশগুলোর উচিত ভবিষ্যতের উন্নয়ন ও সম্ভাবনার দিকনির্দেশনাগুলো তুলে ধরা এবং বৈশ্বিক শাসনের ক্ষেত্রটি আরো বেশি প্রসারিত করা।
একটি নতুন বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা গড়তে হলে চারটি স্তরে সম্পন্ন করতে হবে। এগুলো হলো জাতিসংঘ ব্যবস্থা, জি-২০, ব্রিকস প্লাস ও আঞ্চলিক ব্যবস্থা। এগুলোর মধ্যে জাতিসংঘ ব্যবস্থার স্তরের কাজটি হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বৃহৎ শক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় রূপান্তর করা। এরই মধ্যে বৈশ্বিক শাসনপ্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন ও জনস্বাস্থ্য ইস্যুটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির সমন্বয়ে গড়া বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সংস্থা জি-২০ গোষ্ঠী ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময় বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। এখন নতুন বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ও সরবরাহ চেইন সংকটের প্রেক্ষাপটে ব্রিকসের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে। ‘ব্রিকস প্লাস’ হলো ব্রিকস দেশগুলোর একটি উদ্ভাবন এবং কিছু উদীয়মান শক্তির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা একটি গোষ্ঠী, যা বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা সংস্কারে নতুন প্রেরণা যোগ করছে।
বিদ্যমান আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দুটি ব্লক পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো ও উদীয়মান দেশগুলো—স্নায়ু যুদ্ধকালীন তৈরি হওয়া দুটি বিরোধী শিবির নয়, আবার দুটি ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীও নয়। তারা বরং বিশ্বায়ন ও বৈশ্বিক শাসনপ্রক্রিয়ায় একটি পরিপূরক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তারা একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না এবং তারা একে অন্যের জায়গাও কেড়ে নিতে পারে না। তাই দুই দলের সহাবস্থানের প্রবণতা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় পরিণত হবে।
বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় ব্রিকস দেশগুলোর জন্য দর-কষাকষির দীর্ঘস্থায়ী শক্তি বৃদ্ধি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক আর্থিকব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ধরনের কাঠামোর অযৌক্তিকতা এখন স্পষ্ট। আরো খারাপ দিক হলো, আধিপত্যবাদী দেশগুলো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে দমন করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থায় তাদের অবস্থানকে কাজে লাগায়।
এই আধিপত্যবাদী দেশগুলো তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আর্থিক নীতিগুলো অন্যের স্বার্থের ওপরে রাখে। তাদের নিজেদের মূল্যস্ফীতি বা মূল্যাবনতি যা-ই ঘটুক, তা উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনে, সেটা আর্থিক মন্দা হোক কিংবা সম্পদ ফেঁপে ওঠাই (অ্যাসেট বাবল) হোক। এটি যে ক্ষতির কারণ হবে তা বড় আকারের যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। এমনকি অনেক উন্নত দেশও এই ক্ষতি এড়াতে পারে না। এর আগে ইউরো ও ইয়েন দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থায় একই রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
যত বড় বাধা ও সংকটই আসুক না কেন, ব্রিকস দেশগুলোর আরো ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য বৈশ্বিক শাসন পরিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বন্ধ করা ঠিক হবে না। তাদের বরং বিদ্যমান উন্নয়ন গতি বজায় রাখতে হবে, বিরল ঐতিহাসিক সুযোগ আঁকড়ে ধরতে হবে এবং বৈশ্বিক শাসন সক্ষমতা ও কণ্ঠস্বর তুলে ধরার সমান সুযোগ অর্জন করতে হবে। তাই এই বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন নতুন ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছে।
লেখক : ফুডেন ইনস্টিটিউট অব বেল্ট অ্যান্ড রোড অ্যান্ড গ্লোবাল গভর্ন্যান্সের ভাইস ডিন
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন