আব্দুদ্দাইয়ান মুহাম্মদ ইউনুছ
আমি ১৯৮০ এর দশকে ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভুমিকা বইটি যখন পড়ি তখন শাহ আব্দুল হান্নান-কে (১৯৩৯-২০২১)জানতাম একজন অর্থনীতিবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ একজন আমলা হিসাবে।ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয় ১৯৯৬ সালে। তখন আমি ঢাকায় কলাবাগান থাকতাম। তারপর থেকেই তাঁকে চাচা ডাকি। ২০০০ সালে আমি লন্ডন আসার পর যতবারই দেশে গিয়েছি প্রায়ই চাচার সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটানোর চেষ্টা করতাম। চাচা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত তাঁর চেনা-জানা লোকজনদের খোঁজখবর নিতেন আর দাওয়াহ কাজের অবস্থা জানতেন। আর আমিও বাংলাদেশসহ মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন বিষয়ে চাচার মতামত জানার চেষ্টা করতাম এবং নোট করতাম। মাঝে মধ্যে ইমেইল এ চাচার সাথে যোগাযোগ হতো। মূলত ইমেইলে দাওয়াহ কাজ ও যোগাযোগে চাচা ছিলেন অনন্য।
চাচা ছিলেন আমার অভিাবক, মেন্টর,গাইড ও অনুপ্রেরণার উতস। তিনি বিভিন্ন অর্থ-সামাজিক, একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি অনেক বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। ১২/১০/২০০৬ ‘ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক নলেজ এন্ড রিসার্চ’ (ফিকর) গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘ইসলামী গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থার সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শিরোনামে একটি কর্মশালা এবং ‘ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থার ভূমিকা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কবি আল মাহমুদ এবং চাচা উক্ত প্রোগ্রামে অতিথী ছিলেন।চাচা গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘‘ এ যুগ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। এ যুগে যেসব দেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সবার চেয়ে এগিয়ে। সে সব দেশে সামাজিক সমসা ব্যাপক এবং নৈতিকতার মারাত্মক বিপর্যয়ের সন্মুখীন হওয়া সত্বেও কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হওয়া এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কারণে বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের জন্য পাশ্চাত্যের মূল চ্যলেঞ্জ হচ্ছে বৃদ্ধিবৃত্তিক। তারা প্রশ্ন তুলছে যে ইসলামে মানবাধিকার নেই। নারীর অধিকার বিপন্ন। সেক্যুলার ব্যবস্থা শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি। এসব অসংখ্য প্রশ্নের বৃদ্ধিবৃত্তিক এবং একাডেমিক জবাব দিতে হবে। মুসলিম বিশ্বের সামনে অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে অসংখ্য যোগ্য লোক বিশেষ করে রহঃবষষবপঃঁধষ তৈরী করা।আমাদের জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ হচ্ছেন আখেরী নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সা)। আমরা শাহ আব্দুল হান্নান সাহেব এর জীবনী আলোচনা করছি এইজন্য যে, আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন , উযকুরু মাহাসিনা আমওয়াতিকুম‘ তোমরা তোমাদের মৃতদের ভাল দিকগুলো আলোচনা করা। কারো মুত্যুর পর তার ভাল বা মন্দ কাজের স্বতস্ফুর্ত সাক্ষী দিয়ে মানুষ ভাল বা মন্দ যে মন্তব্য করে আল্লাহর ফেরেশতারা তা রেকর্ড করে। আল্লাহ তায়ালা তা শোনেন। শাহ আব্দুল হান্নান চাচার মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেভাবে দুআ হচ্ছে এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়? তিনি জীবিত অবস্থায় হ্রদয় দিয়ে সকল স্তরের মানুষকে ভালবাসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রমানিত হয়েছে যে তাঁকে অসংখ্য মানুষ কত বেশী ভালবাসে? মানুষের এই ভালবাসার বহিপ্রকাশ এই কথাই প্রমান করে যে , তিনি আল্লাহর মাহবুব বান্দাহদের একজন। তাই তাঁর জীবন থেকে আমাদের জন্য শিক্ষনীয় দিকগুলো আলোচনা করা গুরুত্বের দাবীদার। কারণ আজকের পৃথিবীতে ৮ বিলিয়ন এর মত মানুষ আছে। কিন্ত আদর্শ মানুষ কতজন আছে ? সমাজে আদর্শ মানুষের বড় অভাব। উন্নত চিন্তার অধিকারী মহত মানুষের অভাবেই আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছেনা। যারা আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদেরকে শুধু সত হলে চলবেনা। সততার সাথে যোগ্যতা ও দক্ষতার সমন্বয় থাকতে হবে। আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে শাহ আব্দুল হান্নানের মত সত, যোগ্য, দক্ষ, বহু-মুখী মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মহত মানুষ হতে হবে।
আমরা আসহাবে রাসুল দেখিনি। তাবেঈ-তাবঈ তাবেঈী দেখেনি। কিন্তু তাঁদের জীবনী পড়েছি। শাহ আব্দুল হান্নান এর সততা,অনাড়ম্বরজীবন যাপন, আমানতদারীতা, উদারতা, মহানুভবতা, সময় ব্যবস্থাপনা, সঠিক কথা স্পষ্টভাষায় বলা, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, কথা ও কাজের মিল থাকা, মুআমেলাত ও কুরআন-সুন্নাহর সঠিক বুঝ এবং তার প্রচারে সার্বক্ষনিক প্রচেষ্টাসহ নানাবিধ গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলে এই কথা আমার হ্রদয় সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তাঁর চরিত্রে আসহাবে রাসুলের বাস্তব অনুসরণের অনেক নমুনা পাওয়া যায়। যা বর্তমান সময়ে অনেক জ্ঞানী-গুণীদের জীবনে দেখা যায়না। অনেক গুণী মানুষের কাছে গেলে তার প্রতি পোষণ করা শ্রদ্ধায় ভাটা পড়ে। কিন্তু চচা ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর কাছে গেলে আরও কাছে যেতে মন চাইতো।
প্রতিবারই দেখা হলে শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেতো। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ক্লাসে যেমন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চিন্তার খোরাক পাওয়া যেতো চাচার সাথে আলাপ -আলোচনায় সব সময় নতুন কিছু চিন্তার খোরাক মিলতো। তিনি সব সময় উপেদেশ দিতেন, আমাদেরকে অধিক পড়াশুনা, অধিক লেখ এবং অধিক দাওয়াতের কাজ করতে হবে।চাচা বাংলাদেশ সরকারের সচিব, জাতীয় রাজস্ববোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যংকের ডেপুটি গভর্ণর এর মত গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে ইসলামী ব্যংকের চেয়ারম্যান, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইবনে সীনার ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বহুগুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালণ করেন। এর মধ্যেও তিনি অসংখ্য মানুষকে ব্যক্তিগত সাহচর্য্য দিয়েছেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে
আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তির কয়েকটি বই তিনি সম্পাদনার সময় পেলেন কি করে? সমাজ সংগঠন ইসলামী দৃষ্টিভংগী,ভারসাম্যপুর্ণজীবন ও সময় ব্যবস্থাপনা বইতে তিনি অভিমত লিখেছেন। ক্যরিয়ার গঠন ও দক্ষতা উন্নয়ন মুসলিম যুব সমাজে সময়ের দাবী, মানুষের শেষ ঠিকানা ও সাইয়েদ কুতুব জীবন ও কর্মসহ বিভিণ্ণ বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে আমাকে উতসাহিত করে বলতেন , ‘‘ চাচু তোমাকে কারজাভী হতে হবে‘‘। যদিও তাঁর আশে পাশে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু চাচার দেয়া ভিশন, উতসাহ, মোটিভেশন, বাস্তব গাইডলাইন আমার জীবনে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করছে। তিনি আমার দেখা ভাল মানুষদের মাঝে অন্যতম সেরা ভালমানুষ। আমার দৃষ্টিতে তিনি প্রচলিত অর্থে নেতা ছিলেননা বরং অনেক নেতার মেন্টর ছিলেন। তাঁর কোন পিএইচডি ডিগ্রি ছিলনা। কিন্তু অসংখ্য পিএইচডি ডিগ্রিীধারীর তিনি বাস্তব গাইড ছিলেন। আমি মনে করি তাঁর জীবনের বিভিণœ দিক ও চিন্তাধারা নিয়ে পিএইচডি গবেষনাসহ রিসার্চ হওয়া দরকার। তিনি কুরআন- সুন্নাহর টেক্ট বর্তমান কনটেক্ক্রট এর আলোকে বুঝতে এবং প্রয়োগ করার প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর চিন্তা, ভাষা ও উপস্থাপনায় ছিল ওয়াসাতিয়্যাহ মানহাজের বহিপ্রকাশ। উগ্রতা বা গোঁড়ামী তিনি সাপোর্ট করতেননা আবার ফাহেশা-অশ্লীলতা বন্ধে তিনি ছিলেণ আপোষহীন।
তিনি সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ের দায়িত্ব পালন করে দুর্নীতি ত দুরের কথা বৈধভাবে ঢাকায় একটি প্লট পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘ ঢাকায় গোড়ানে আমার পৈত্রিক সম্পদে আমার অংশ আছে। ঢাকায় আমার কিছু নেই এই ধরনের মিথ্যা কাগজে সাক্ষর আমি দিতে পারবনা। আর আমি মাসিক কিস্তির টাকাই বা কিভাবে পরিশোধ করব‘‘? আমি তাঁর সেগুণ বাগিচার বাসাতেও গিয়েছি এবং গোড়ানের বাসাতেও গিয়েছি। ভোগ বিলাস পরিহার করে সাদা-সিধে জীবন যাপন করেতিনি আজ সকলের শ্রদ্ধা ও অনুপ্রেরণার উতস।
আমরা অনেক সময় অপরের সমালোচনায় প্রচুর সময় নষ্ট করি এবং হর-হামেশা গীবত করি। আমি চাচাকে কখনও কারো গীবত করতে দেখেনি। তিনি সব সময় সকলের ইতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলতেন। তিনি অনর্থক বা অপপ্রয়োজনীয় কথা বলতেননা।শুধু অর্থের অপচয় নয় তিনি কথা বলার সময় শব্দের অপচয় করেছেন আমি তা দেখেনি। তিনি অনেক বড় বড় বা জটিল বইর সার সংক্ষেপ বোধগম্য ভাষায় সংক্ষেপে প্রচার করতেন। ফিকহসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতের যারা সমালোচনা করতো তিনি তাদের প্রতিও ছিলেণ শ্রদ্ধাশীল। তাঁর চিন্তার কোন ভুল সঠিক প্রমানসহ কেউ ধরিয়ে দিলে সাথে সাধেথ সংশোধন করে নিতেন।অহেতুক বিতর্ক করতেননা। ইখতিলাফ যেন ইফতেরাক তথা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে না যায় তিনি তা বারবার বলতেন।
শাহ আব্দুল হান্নান চাচার অনেক গুণাবলী রয়েছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তাঁর বড় গুণ হচ্ছে, তিনি ছিলেন সত্যিকারের দায়ী ইলাল্লাহ। শুধু মৌখিক দাওয়াত নয় বরং বাস্তব জীবনে সত্যের সাক্ষ্য ছিলেন। যার কাছে সব সময় অপরকে দাওয়াত দেয়ার জন্য কোন বই বা আর্টিকেল থাকতো। যিনি হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সদের মাঝে দাওয়াত দিতেন। রিকশায় চলতে রিকশা চালককেও দাওয়াত দিতেন। আবার বড় বড় সরকারী আমলাদেরকেও দাওয়াত দিতেন। তিনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে সার্বক্ষনিক দায়ী ছিলেন। তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। সদকায়ে জারিয়ার অনেক কাজ তিনি করেছেন। তিনি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তিনি ছিলেন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর; তিনি অনেক লোক তৈরী করেছেন। পৃথিবীতে অনেক যোগ্য মানুষ আছেন। কিন্তু শাহ আব্দুল হান্নান চাচার মত কয়জন আছেন যারা সত যোগ্য লোক তৈরীকে জীবনের মিশন হিসাবে গ্রহণ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য তুরণ-তরূনী আজ তাঁর জন্য অশ্রুসিক্ত নয়নে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছে। তিনি মানুষের সমস্যা সমাধানে ছিলেণ অত্যন্ত আন্তরিক। আমার মনে পড়ে ২০১৪ সালে তিনি আমাকে ইমেইল করেছেন এবং ফোন করেছেন তাঁর কাছে যাওয়া একজন ভাইয়ের একটি সমস্যা সমাধানে আমি কিছু করতে পারি কিনা?
মানুষ মরণশীল। কার কখন মরণ হবে জানিনা। মৃত্যুই পৃথিবীর সব চেয়ে বড় বাস্তবতা। মানুষের মৃত্যুর পর চেনা-জানা মানুষেরা কিছু দিন শোকাহত থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যায়। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম নেয় তারা মরেও হ্রদয়ে অমর থাকে। তাদের চিন্তা ও কর্মের প্রভাব জীবিত থাকার সময়ের চেয়েও অনেক সময় মরণের পর বেশী অনুভত হয়। শাহ আব্দুল হান্নান এমন একজন ব্যক্তি যিনি মৃত্যু বরণ করার পরও সকলের হ্রদয় রাজ্যে অমর। যাঁর চিন্তা ও কর্ম অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাই সকলের হ্রদয়ে আজ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সকলেই অশ্রুভেজা নয়নে মনীবের দরবারে ফরিয়াদ করছে, ‘‘হে আরশে আজীমের মালিক শাহ আব্দুল হান্নানের সকল নেক আমল সমূহ কবুল কর। মানবিক দুর্বলতাসমূহ ক্ষমা করে দাও।তাঁকে রহমতের চাদরে জড়িয়ে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান কর‘। হে আল্লাহ শাহ আব্দুল হান্নান যে ভাবে সদকায়ে জারিয়ার অনেক কাজ করেছেন। আমাদেরকে সদকায়ে জারিয়ার কিছু কাজ করার তাওফিক দান কর। হে আল্লাহ আমাকে এমনভাবে আমরণ আমলে সালেহ করার তাওফিক দান কর যাতে জান্নাতে তোমার নেক বান্দাহরা যখন তোমার দীদার লাভ করবে আমিও তাদের সাথে জান্নাতে তোমাকে দেখতে পারি। আমীন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন