আরিফুল হক
১৯৭১ সালের পর থেকেই একটা ‘মিথ’ বাংলাদেশের মানুষের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা হল ‘ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র’। যে কথার কোন ভিত্তি নেই, যা সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আমরা যদি ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পূর্বলগ্ন থেকে ভারতের ‘ফালনামা’ নিয়ে একটু অনুসন্ধান করি তাহলে দেখতে পাব, ভারতের ‘জন্মকুষ্ঠি’ তে ‘বন্ধু’ শব্দের কোন চিহ্নই নেই। যা আছে তা হল, হিংসা, হিন্দু সা¤প্রদায়িকতা, পররাজ্যলোভ, পর সম্পদ লুণ্ঠন এবং ইচ্ছাপূরণের প্রবল ইচ্ছাপ্রভাবে ভরপুর। যদি বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখতে পাব-
ভারতীয় নেতা জওহরলাল নেহেরুর খাবনামা বলছে-
“India will be the hub of all political and economic activities in Indian ocean region, there is no further role for small communities . They can only survive as a cultural entity, not as an independent political entity.” (Discovery of India )
ভারতের আর একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক জধনর- Rabi-Rikhye তার “The war that never was” (On Indian military strategic history 1947-1971) বইতে লিখেছেন-
“We will have to start reunification process whatever the consequences might be. Once Pakistan is merged with us, then other states will come back easily with shortest possible time.”
এবার আসুন দেখি এসব ডকট্রিন ভারত কার্যকর করেছে বা করছে কিভাবে?
১৯৪৭ সালের আগে বৃটিশ শাসনের সময় ভারত উপমহাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে সর্বমোট ৫৬৫ টি ‘প্রিন্সলি স্টেট’ অর্থাৎ দেশীয় রাজ্য ছিল। যাদের স্বাধীন থাকার অথবা পাকিস্তান বা ভারতের সাথে মিলে যাওয়ার অধিকার স্বীকৃত ছিল। ভারত কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অথবা সেনা অভিযান চালিয়ে ৫৬৫ টি দেশীয় রাজ্যের ৫৫২ টি দখল করে নেয়।
ভারত যে রাজ্যে গুলো সেনা অভিযান চালিয়ে দখল করেছে, তার মধ্যে আছে, ১) গোয়া দমন দিউ, ২) পন্ডিচেরী ৩) জুনাগড় ৪) হায়দারাবাদ ৫) কাশ্মীর ৬) সিকিম ৭) জম্মু কাশ্মীর। নেপাল এবং ভুটানকে ভষিভূত করে দেশ দু’টির সাথে করদ রাজ্যের আচরণ করে আসছে। একাধিকবার পাকিস্তান আক্রমণ করে অবশেষে তার পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
তাছাড়া ভারত, শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের অস্ত্র এবং সেনা সাহায্য করে দেশটির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মেরুদÐ ভেঙ্গে দেয়। ভারত, মালদ্বীপে সেনা অভিযান চালায়। প্রতিবেশী চীনের সাথে তাদের সতত বৈরী ভাব! পাকিস্তানের সাথে প্রতিনিয়ত গোলাগুলি করছে। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা গুলোতে তো পাখি শিকারের মত নিরীহ বাংলাদেশীদের গুলী করে মারছে! ভারত যুগের পর যুগ ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী চাকমাদের নিজের দেশে রেখে, আশ্রয় দিয়ে, নাশকতার ট্রেনিং দিয়েছে। তারপর, অস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে নাশকতামূলক কাজ করার জন্য। তাদের জন্য বাংলাদেশের পার্বত্যচট্টগ্রাম অশান্ত টালমাটাল হয়ে আছে।
এরকম একটি পররাজ্য লোভী, আধিপত্যবাদী, রক্তলোলুপ বৈদিক ভ্যাম্পায়ার রাষ্ট্রকে যদি কেউ ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ বলে প্রচার করে, তখন তাদের অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শংকিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকা উচিত।
বাংলাদেশের আকাশে কি আজ সিকিমের ছায়া?
২৭৮৩ বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশ ছিল সিকিম। সিকিম অর্থ ‘সুখের নিবাস’। প্রকৃত অর্থেই সিকিম একদিন সুখের নিবাস ছিল! হঠাৎ ভারত নামের লোভী ব্যাধের শ্যেনদৃষ্টি গিয়ে পড়ল সিকিমের ওপর। বিষাক্ত তীর বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লো পাহাড়ি কন্যা! আজও তার যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ের আর্তিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার বিদীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে সেই আর্তি, সেই চাপা কান্না?
সেই সিকিমের সাথে বাংলাদেশের বহুলাংশে মিল পাওয়া যাচ্ছে। তাই সিকিমের ইতিহাস জানা এবং ভারত যে বন্ধুবেশী কত বড় দুষমণ, তা চিনে নেয়া এখন সময়ের দাবী।
ভারতীয় রাজনীতিবিদদের পররাজ্য গ্রাসের মূল কৌশলই হলো, তারা উপমহাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রেই তাদের পোষ্য কিছু লোকজন এবং অনুগত রাজনৈতিক দল তাবেদারিতে রাখতে সক্ষম হয়। সেই কৌশল অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের আগে থেকেই ভারত, সিকিমেও কয়েকটি ভারত অনুগত রাজনৈতিক দল পুষে আসছিল। এদের মধ্যে ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’, প্রজা সম্মেলন পার্টি এবং ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’ ছিল অন্যতম।
এই ভারতপন্থী দলগুলির কাজই ছিল দেশে চিরস্থায়ী-বিশৃঙ্খলা, গোলমাল, অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশটিকে অস্থিতিশীল করে তোলা। ভারত সহযোগী দলগুলোর অসহযোগিতা, বিশৃঙ্খলা এবং অপকৌশলের ফলে দেশে সর্বজনগ্রাহ্য এবং স্থিতিশীল সরকার গঠন করাই সিকিমে দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো। একদিকে ভারতীয় চাপ অন্যদিকে ভারত-পোষ্য দলগুলির বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, উভয় সংকটের মাঝে পড়ে সিকিমের রাজা চোগিয়াল একদিন ভারতের পাতা ফাঁদে ধরা দিতে বাধ্য হলেন। তিনি দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করলেন।
এই সুবর্ণ সুযোগে ভারতের ‘বৈদিক কোবরা’ নামে পরিচিত স¤প্রসারণবাদী নেতারা ভুটানের মত সিকিমের কাছেও দাবী করলো যে, সিকিমের বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, ভূরাজনৈতিক ও সড়ক যোগাযোগের দায়িত্ব ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এসব দাবি মেনে নিয়েই সিকিম ভারতের সাথে এক চুক্তি করতে বাধ্য হয়। চুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, বর্তমান সময়ের জন্য একজন ভারতীয় কর্মকর্তা সিকিম রাজ্যের দেওয়ান হিসাবে রাজ্যের কার্যাদি পরিচালনা করবেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিবাদী সরকারগুলোর চুক্তি সমূহের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
যাইহোক, ছলনাময়ী ভারত একদিকে যেমন চুক্তির খেলা খেলতে থাকে। অপরদিকে নেপাল ও পশ্চিমবঙ্গের গুর্খা এলাকাগুলো থেকে গুর্খালী ভাষাভাষীদের এনে সিকিমে পুনর্বাসিত করার কাজটিও কৌশলে সেরে ফেলে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সিকিমে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিনিধি হরিশ্বর দয়াল, গ্যাংটকে বসেই পুনর্বাসিত এইসব গুর্খালী ভাষাভাষীদের নিয়ে গোপনে চোগিয়াল বিরোধী তৎপরতা শুরু করে দেয়।
ভারতীয় গুর্খাদের সিকিমে পুনর্বাসিত করার পর, সিকিমে ১৯৬৭ সালে এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিকভাবে সে নির্বাচনে ভারত পরিচালিত রাজনৈতিক দল ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। উক্ত নির্বাচনে দেশের ১৮টি নির্বাচিত আসনের মধ্যে, সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস পায় ৮ টি এবং অপর ভারতপন্থী দল সিকিম স্টেট কংগ্রেস পায় ২টি আসন।
দেশের পার্লামেন্টে ভারতপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে সিকিম হয়ে পড়ে ভারতীয় অপতৎপরতা এবং ষড়যন্ত্রের তীর্থক্ষেত্র ।
দেশে হাজার হাজার গোপন অস্ত্র আসতে থাকে। কোলকাতা থেকে ট্রাকভরে আসতে থাকে বিস্ফোরক দ্রব্য। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সমস্ত প্রস্তুতি শেষে ‘র’ ফাইনাল খেলার জন্য মাঠে নামে।
রাজা চোগিয়ালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার জন্য তারা বহিরাগত নেপালীদের ইন্ধন যোগায়। প্রফেশনাল কিলারদের হাতে টাকা এবং অস্ত্র দিয়ে বড়বড় জাতীয়তাবাদী নেতাদের হত্যা করানোর ব্যবস্থা করে। ‘র’ এর নির্দেশে চারদিকে অরাজকতা, বোমা বিস্ফোরণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি নাশকতামূলক তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়।
এমনি এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে, চোগিয়ালকে রক্ষার অজুহাতে ভারতীয় বাহিনী সিকিমে ঢুকে পড়ে।
অতঃপর রাজা চোগিয়াল একটি পুতুল সরকারের মত ভারতীয় নির্দেশ পালন করে দেশ পরিচালনা করতে বাধ্য থাকেন।
১৯৭৪ সালের ২৩ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায়, রাজা ‘একজন, একভোট’ ভিত্তিতে নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে ভারতের অনুগত ‘সিকিম স্টেট কংগ্রেস’ পার্লামেন্টের ৩২ টা আসনের মধ্যে ৩১টিই দখল করে নেয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে ভারতের ইচ্ছায়, ভারতের হাতের পুতুল কাজী লেন্দুপ দর্জি মন্ত্রীসভা গঠন করে।
নেতৃত্বের আসনে বসেই লেন্দুপ দর্জি ভারতের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা ঘোষণা করলেন এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতামূলক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করলেন। লেন্দুপ দর্জির প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতীয় পার্লামেন্টে সিকিমকে সহযোগী রাষ্ট্র হিসাবে গ্রহণের জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী ১৯৭৪ (৩৬তম সংশোধনী) গ্রহণ করে।
সহযোগী রাষ্ট্র নয়, ভারতের লক্ষ্য ছিল সিকিমের স্বাধীনতা আত্মসাৎ করা। সেই লক্ষ্যে ‘র’ এর কর্মসূচি অনুযায়ী রাজা এবং জাতীয় পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। র’ অপারেটররা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নানান ভাবে ইন্ধন যোগাতে থাকে।
দেশের এরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি ১৯৭৫ সালের ১০ই এপ্রিল জাতীয় পরিষদে এক প্রস্তাব পাস করান। প্রস্তাবে বলা হয় “এখন হইতে চোগিয়ালের (রাজা) পদ বিলোপ করা করা হইল এবং এই মূহুর্ত হইতে সিকিম ভারতের সাংবিধানিক অংশ হিসাবে পরিগণিত হইবে।” এরপর সিকিমের স্বাধীনতা হরণের শেষ দৃশ্যটি অতি দ্রæত অভিনীত হয় ।
১৯৭৫ সালের ২৬ এপ্রিল ভারতীয় সংবিধানের ৩৮ তম সংশোধনী পাস করে ৩৩৩ বছরের স্বাধীন দেশ রূপকথার রাজ্য সিকিমকে ২২তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে আত্মসাৎ করে নেয়। বন্ধুর বেশে এত বড় শত্রæ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শ্রী অশোক রায়না তার ‘ইনসাইড ‘র’ বইতে লিখেছেন- “ভারত শুধু দেশটিকে আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত হয়নি। চার বছর পরেও ভারতীয় ‘র’ (স্বাধীনতা পূণরুদ্ধারকারীদের ভারতের ভাষায়) গণতন্ত্রে বাধাদানকারীদের ধ্বংস সাধনে ব্যস্ত ছিল।”
বর্তমান বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীদের তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা এসব কি তবে সিকিমের আলামত?
বাংলাদেশ সরকারের ভারতপ্রেম, সিকিমের লেন্দুপ দর্জির কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে র’ এর অপচেষ্টা, র’ অপারেটরদের বিভিন্ন অফিস আদালতে বসানো, ভারতীয় দালালদের উজাড় করা ভারতপ্রেম প্রচার কি সিকিমের কথাই মনে করিয়ে দেয়না?
সিকিমের জনসাধারণ লেন্দুপ দর্জি কে চিনতে ভুল করেছিল। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ যদি নব্য লেন্দুপ কে চিনতে ভুল করে, যদি ভারতীয় ‘র’ এর দুরভিসন্ধি উপলব্ধি করতে না পারে, ‘র’ অপারেটর এবং ভারতীয় দালাল বাহিনীর বিরুদ্ধে যদি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সিকিমের মত বাংলাদেশও অচিরেই তার স্বাধীনতা হারাবে!
লেখক: প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, কলামিষ্ট।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন