বিকেল থেকেই উৎকণ্ঠায় আছি। সানাউল্লাহ ভাইয়ে শরীর ভাল নেই খবর জেনে। সন্ধ্যা পেরিয়ে মাত্র রাত শুরু। এশার নামাজ শেষ করেছি । হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করার আগেই চোখে জ্বল চলে এসেছে। জানি খবর ভাল নয়। রিসিভ করতেই অনেক কান্নার শব্দ কানে ভেসে এলো। ওপাশ থেকে বললো-সানাউল্লাহ ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। আমি কণ্ঠহীন নির্বাক।
তখন ওয়ান ইলেভেন চলছে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুজনেই সাবজেলে বন্দি। দু’দলের হেভিওয়েট নেতারাও জেলে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তখন থমথমে অবস্থা। তখন রাজনৈতিক বিটের সাংবাদিকরা খুবই ব্যস্ত সময় কাটায়। নতুন তথ্য সংগ্রহে রাজনৈতিক বিটের সংবাদকর্মীরা যে যার সর্ম্পকগুলো জোড়দার করেন। আমি তখন বিএনপি বিটের তুলনামূলক জুনিয়র রিপোর্টার। দৈনিক জনতা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে মাঠে ময়দানে ঘুরি ফিরি।
সাবজেলের সামনে প্রতিদিন যাই। নতুন তথ্যের জন্য বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব মান্নান ভূইয়া ও সংস্কারপন্থীদলের মহাসচিব মেজর অব. হাফিজের বনানীর বাসা ও পরে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ন্যাম ভবনের বাসা আর মহাখালী ডিওএইচএসে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. আ স ম হান্নান শাহ বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করা লাগতো। প্রায় যাওয়া হত পরীরবাগে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে। ওখানে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ মাঝে-মধ্যে কথা বলতেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আমার চেনাজানা ছিল খুবই কম। একদিন সকাল বেলা ন্যাম ভবনে গিয়ে বসে আছি। তখন কোন নেতা আসেনি। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব উদ্দিন আর খাটো করে একজন লোক এলেন। পরে ওই খাটো লোকটার সাথে আমাকে পরিচয় করে দেন সোহরাব ভাই। সেই খাটো লোকটি ছিলেন, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। আমি মোবাইলে তার নম্বর সেইভ করে নেই সানা মিয়া নামে। ওইদিন থেকে যেকোন সময়, যেকোন তথ্যের জন্য ফোন দিলেই রিসিভ করতেন। ব্যস্ত থাকলে ফ্রি হয়ে ফোন ব্যাক করতেন। আর কথা বলার শুরুই করতেন, কবি ভাই বলেন দেশের খবর কী? প্রায় কথা হত। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা বিষয়ে অনেক জ্বালাতন করতাম। কোর্টে গেলেই ইলিশ ভাঁজি দিয়ে আমাকে ভাত খাওয়াত। না খেলে আসতেই দিত না। সব সময় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন। কোন ক্লান্তি ছিল না তার চোখে মুখে। যে মামলার সাথে বিএনপি নাম জড়িত, সে মামলার সাথে ওনার আত্মার একটা সর্ম্পক হয়ে ওঠে।
২০১৬ সালের শেষের দিকে দৈনিক বর্তমান পত্রিকা নতুন করে যাত্রা শুরু করলো। নতুন এ যাত্রায় আমিও জয়েন করি বিএনপি বিটের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। কিন্তু নতুন কোন ব্রেকিং রির্পোট দিতে পাচ্ছি না । খুব টেনশনে একদিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির বাগান বাড়িতে বসে আছি। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বাজলো। মোবাইল মনিটরে ভেসে ওঠে সানা মিয়া বিএনপি। ফোন রিসিভ করতেই সেই শিশু সুলভভাবে বলে কবি চেম্বারে চলে আসেন। কিছু কথা আছে। আমিও গেলাম চেম্বারে। সানা ভাই বসে আছেন। কিন্তু মনটা তার বেশ ভার। বসার পর চায়ে কথা বললেন। ফাইলগুলো গুছিয়ে আমার সাথে কথা বলতে -বলতে তার চোখে পানি চলে এলো। কণ্ঠছোট হয়ে গেলো। ভারী ভারী কণ্ঠে বললো ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে সাজা দেবে। এটা চূড়ান্ত । মামলা সেদিকে এগুচ্ছে। এরপর অনেক গল্প সেরে চা পান করে চলে এলাম। অফিসে এসে নিউজ লিখে জমা দিলাম। পরদিন দৈনিক বর্তমান পত্রিকার প্রথম পাতায় লিড নিউজ হলো ‘সাজা হতে পারে খালেদা জিয়ার’। এ নিউজ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইতে থাকলো। নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয় থেকে গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় পর্যন্ত।
পরিচিত অনেক নেতা ফোন করে আমাকে তিরস্কারও করলো। এমনকি আমার রিপোটিং যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুললো। আমিও মানষিকভাবে একটু দুর্বলই হলাম। কারণ, সহযোদ্ধা ভাই বন্ধু অনেকেই আড়ালে আবডালে আমাকে নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। মনটা খারাপ হলো। ফোন দিলাম সানা মিয়া ভাইকে। জানালাম নিউজ হওয়ার পর তিক্ত অভিজ্ঞার কথা। তিনি হাঁসলেন আর বললেন কবি ভাই, আজ যারা আপনার রিপোর্ট নিয়ে তিরস্কার করছেন, আপনার রিপোটিং যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা সেদিন লজ্জায় আপনার সামনে আসতে পারবেন না, যেদিন প্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে চলে যেতে হবে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। সন্ধ্যায় ফোন দেন সানা মিয়া ভাই। বললো সেদিনের নিউজ আজ সত্য হলো। কিন্তু আফসোস বিএনপির জন্য অন্ধকার নেমে এলো।
এরপর দেখা হলে, কিংবা কথা হলে, একই কথা বলতো ম্যাডাম খালেদা জিয়া কবে মুক্ত হবেন। তাকে কবে মুক্ত করে গুলশানের বাসায় নিতে পারবো। আজ কষ্ট এটাই, খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে গুলশানের বাসায় গেলেন। আর আপনি মুক্তি নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এমন তো কথা ছিলো না সানা মিয়া ভাই। খুব কি তাড়া ছিলো চলে যাবার...
এম উমর ফারুক
লেখক-সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক স্বদেশ প্রতিদিন
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন