মোহাম্মদ হানিফের কলাম
মূলত গোটা কাশ্মির এখন অবরুদ্ধ। চারদিকে আতঙ্কিত পরিবেশ তৈরি করে কাশ্মিরি জনগণের সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে গোটা ভূ-স্বর্গকে নরকে পরিণত করার দিকে হাঁটছে ভারত। সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মিরের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা নজিরবিহীন। এই ঘটনা নিয়ে লিখেছেন খ্যাতিমান পাক ঔপন্যাসিক মোহাম্মদ হানিফ। নিউইয়র্ক টাইমস থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন তুহিন মোহাম্মদ।
স্কুলের ভিতরে ও বাইরে পাকিস্তানি কিশোরেরা ভাবে কাশ্মির তাদের ঘাড়ের রগ (শিরা)। আর ভারতীয়রা মনে করে, কাশ্মির তাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। উর্দু এবং ফার্সি কবিতা কাশ্মিরের সৌন্দর্য্যের স্তুতিতে পরিপূর্ণ। চতুর্দশ শতকের কবি আমির খসরু লিখেছিলেন, “যদি পৃথিবীতে কোন জান্নাত থেকে থাকে, তবে “তা এটাই , তা এটাই, তা এটাই।” আজ থেকে ৭২ বছর আগে দেশভাগের সময় থেকে ভারত এবং পাকিস্তান কাশ্মিরকে নিয়ে লড়াই করে আসছে এবং প্রত্যেকেই নিজেকে কাশ্মিরের হকদার দাবি করছে— একজন অপরজনকে কাশ্মিরের অত্যাচারী বলে সম্বোধন করে আসছে।
তারা সবসময়ই বলে যে তারা স্বাধীনতা চায়। কোন বিশেষ মর্যাদা কিংবা ভারত ও পাকিস্তানের সাথে যাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু চায়, তারা একা থাকতে চায়। ভারত এবং পাকিস্তান থেকে আলাদাই থাকতে চায়।
মাঝেমধ্যে সেখানে অর্থহীন প্রতিশ্রুতি দেখা যায়। বলা হয় যে, কাশ্মিরি জনগণ তাদের জান্নাত নিয়ে যা করতে চায় তা তাদের করতে পারার অধিকার থাকা উচিত। ১৯৪৮ সালে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ‘গণভোট’ এর মাধ্যমে একটা ঘোষণা দেয় যে, কাশ্মিরি জনগণ তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে। কিন্তু সেটা আদতে ঘটলো না। কাশ্মিরের দুই ভূ-খণ্ডের আমার দু’জন বন্ধু আছে, এবং তারা সবসময়ই বলে যে তারা স্বাধীনতা চায়। কোন বিশেষ মর্যাদা কিংবা ভারত ও পাকিস্তানের সাথে যাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু চায়, তারা একা থাকতে চায়। ভারত এবং পাকিস্তান থেকে আলাদাই থাকতে চায়।
যাইহোক এরা এবং অন্য কাশ্মিরিরা যাই চেয়ে থাকুক না কেন, আমি নিশ্চিত যে এই সপ্তাহে তারা যা পেয়েছে তা তারা চায়নি: ভারতের সংবিধানের অধিনে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা এবং স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার বাতিল করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক অধ্যুষিত এলাকায় ৩৫০০০ হাজার সশস্ত্র সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, অফিস-স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, ল্যান্ডলাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কারাবন্দী করা হয়েছে— এমনকি যারা ভারতীয় প্রশাসনের সাথে সাচ্ছন্দ্যে কাজ করেছেন সে সব নেতাদেরও। গ্রেফতারের কিছুক্ষণ আগে প্রদেশটির সাবেক এক মূখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশভাগের সময় ভারতের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এবং এখন ভারত কাশ্মিরকে দখল করে এবং তার হাজার হাজার নাগরিককে বন্দি করে আমাদের দেশভাগের যুগেই ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
অনেক ভারতীয়ই এই বন্দিদশায় চিয়ারলিডারের মতো আচরণ করছে। অভিনেতা অনুপম খের টু্ইট করেছেন যে, ‘কাশ্মির সমাধান’ দারুণভাবে শুরু করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞই লিখছেন, কাশ্মির ভারতের সাথে থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পরেও অনেক সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেছে: আপনি দেখবেন, কাশ্মির উপত্যাকায় অনেক যুবকই প্রো-পাকিস্তানি স্লোগান দেয় আবার ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তানের জয় উদযাপন করা সময় অনেক যুবকই পাকিস্তানের পতাকা উড়ায়।
৩৫০০০ হাজার সশস্ত্র সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, অফিস-স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, ল্যান্ডলাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কারাবন্দী করা হয়েছে
এই সপ্তাহে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের আগে, কাশ্মিরিরা তাদের নিজেদের আইন প্রণয়ন করা এবং নিজেদের পতাকা উড়ানোর বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ করতো। এবং কী অসাধারণ এক অধিকার। এর জন্য কত কয়েক দশক ধরে কাশ্মিরিরা শাস্তি পাচ্ছে। হাজার হাজার কাশ্মিরি নিখোঁজ হয়ে গেছে; সেই সকল কাশ্মিরি, যারা ভারতীয় সেনাদের হাতে আটক হয়েছে তারা জানিয়েছে, সেনারা তাদের নিজেদের মাংস খেতে বাধ্য করেছে। এছাড়াও কাশ্মির প্লেট গানের মুখে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাস-ব্লাইডিং এরিয়া।
কাশ্মিরিদের বশে আনাতেই ক্ষান্ত ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চিয়ারলিডারসরা দেশভাগের সংকট, বিশ্বমানের গণহত্যা, জাতিগত নিধনের জন্য চিয়ার্স করতে শুরু করেছে। এর পিছনে রয়েছে হিন্দু আধিপত্যবাদী মানসিকতা
কিন্তু কাশ্মিরিদের বশে আনাতেই ক্ষান্ত ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চিয়ারলিডারসরা দেশভাগের সংকট, বিশ্বমানের গণহত্যা, জাতিগত নিধনের জন্য চিয়ার্স করতে শুরু করেছে। এর পিছনে রয়েছে হিন্দু আধিপত্যবাদী মানসিকতা (যেটা জবানের পূর্বের অনেক লেখাতেই হিন্দুত্বভা বলা হয়েছে- অনুবাদক)। এই আধিপত্যের নিষ্ঠুর শক্তির কাছে নিজস্ব যুক্তি রয়েছে, এবং এটি শুধু কাশ্মিরিদের ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করে না বরং এটি অতীতে ভারতীয়দের প্রতি কৃতজ্ঞ না হওয়ার মতো পাপের (!) জন্য তাদের নিগৃহীত করে এবং শাস্তি দেয়। একই সাথে ভারতজুড়ে অন্যান্য মুসলিমদের গরুর মাংস কেনা-বেচা করার জন্য খুন করা হচ্ছে এবং জোরপূর্বক হিন্দুত্বভার স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, কাশ্মিরিদের গণগ্রেফতার করা হচ্ছে। সুতরাং এখন বলতে বাধ্য হয়েছে— ধন্যবাদ, আমাদের আর আপনাদের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই।
কয়েক বছর আগে যখন একটি নির্বাচনী র্যালিতে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির একজন নেতা বলেছিলো যে মুসলিম নারীদের তাদের কবর থেকে তুলে এনে ধর্ষণ করা উচিত, তখন তার কথা একজন চরম ধর্মান্ধের মতো শোনাচ্ছিলো। কিন্তু ক্রমে দেখা গেলো, এটি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ‘অবশ্য করণীয়’ তালিকার একটি অ্যাকশন পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সপ্তাহের শুরুতে একটি ভিডিওতে একজন তরুণ বলছিলো যে এখন তারা কাশ্মিরি মেয়েদের পেতে পারে। প্রকৃত দেশভাগের সময় নারীরাই বেশি ভিকটিম ছিল যারা ধর্ষিত হয়েছিলো অথবা ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে কূপে ঝাঁপ দিয়েছিলো। এখন ভারতীয় যুবক পুরুষরা মনে করছে সেরকমই একটি ঐতিহাসিক সুযোগ উন্মুক্ত হয়েছে তাদের জন্য।
ভারত এই সপ্তাহে ঘোষণা করেছে, কাশ্মিরের বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে আর কোন বিরোধ নেই। আপনার জমি, কাশ্মিরিদের জমি, আমাদের জমি। পাকিস্তানের ঘাড়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছে।
তবু মনে হয় না শূন্যে হাত তোলা এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে অভিযোগ করা ব্যতিত পাকিস্তানের খুব বেশি কিছু করার আছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা কাশ্মিরি ভাইদের সহযোগিতা করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু যখন ইমরান খান সংসদে বক্তব্য রাখলেন তখন এর সীমা পরিস্কার হয়ে উঠল। ইমরান খান বললেন, আপনি আমাকে কি করতে বলেন? ভারতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে? আমরা ইতিমধ্যে চারবার তা করেছি, এবং আমরা এখন আর সে মুডে নেই।
পাকিস্তান বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন করেছে। কিন্তু বিশ্ব বিবেক বিভ্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে যে সুরক্ষিত ভূ-স্বর্গে যা ঘটছে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এছাড়াও একটি দেশ যারা তাদের নিজেদের ওয়ালমার্টগুলো সুরক্ষিত করতে পারে না তাদের কাশ্মিরের ইন্টারনেট কিংবা মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার সম্ভাবনা কম।
রাশিয়া এবং ইসরায়েল ভারতের কাছের বন্ধু। মুসলিম কমিউনিটির প্রধান যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান মোদিকে ভাই ডেকেছেন। এই সপ্তাহে ভারত সরকারের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানিরা মনে করে সত্যিই ভারত সরকার তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, “কাশ্মির আমাদের”।
পাকিস্তানে সর্বাধিক পুরনো বন্ধু চীন, তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে উইঘুর মুসলমানদের ক্যামেরার সামনে নাচতে ও হাসতে শেখাচ্ছে। রাশিয়া এবং ইসরায়েল ভারতের কাছের বন্ধু। মুসলিম কমিউনিটির প্রধান যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান মোদিকে ভাই ডেকেছেন। এই সপ্তাহে ভারত সরকারের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানিরা মনে করে সত্যিই ভারত সরকার তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, “কাশ্মির আমাদের”।
আমি টুইটারে ভূ-স্বর্গকে খুবই সামান্য ফলো করি। জম্মু পাহাড়ের ব্রেসওয়ানা গ্রামের হাজী পাবলিক স্কুলের ডিরেক্টর সাব্বাহ হাজী। তিনি তার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং ঘোড়া ও কুকুরের স্বাস্থ্য নিয়ে লিখেছেন। শনিবার, যখন ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হওয়া শুরু করেছে তিনি লিখেছেন, “যখন আমাদের ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে, ভুলে যাবেন না আমরা এখনো এখানে আছি।”
পরদিন লিখেছেন : “নীল আকাশের নিচে, আজ একদল আর্মি আমাদের গ্রামে এসেছে। এই সন্ধ্যায় তারা পৌঁছেছে। আমরা সমতল থেকে ৭৫০০ ফিট উপরে।” এবং তারপর নিস্তব্ধতা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন