![](https://opinion.bdnews24.com/bangla/wp-content/uploads/2021/08/taliban-kabul-150821-01-1170x660.jpg)
ইতিহাস বলছে, প্রায় একশ বছর আগে আফগানিস্তানের রানি সুরাইয়া ছিলেন প্রথম আধুনিক মুসলিম নারীর প্রতীক। যিনি সিরিয়ায় পড়াশোনা করেছিলেন। আমীর হাবিবুল্লাহ খানের পুত্র খানের সাথে ভালোবাসা হয়েছিল তার। তখন তিনি কিশোরী। কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া সুরাইয়ার মাথায় মুকুট ওঠে ১৯১৯ সালে। যখন তার পতি আফগান রাজার সিংহাসনে বসেন।
মনে করা হয়, তিনিই প্রথম মুসলিম নারী যিনি তার স্বামীর সাথে প্রকাশ্যে ভ্রমণের সাহস দেখিয়েছিলেন। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে ইউরোপ ভ্রমণের সময় তাকে দেখার জন্য রাস্তায় মানুষের ঢল নামতো। টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালী নারীদের নামের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিলেন সুরাইয়া।
সেই আফগানিস্তান এমন এক যুগে প্রবেশ করলো যার নাম অন্ধকার যুগ। কেন এমন হলো? কেন বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ?
আফগানিস্তানে আমেরিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘মরিয়া’ চেষ্টাও এ সরকার বিরোধিতার পেছনে কাজ করে থাকতে পারে। কেননা আফগানিস্তানের একটিও সরকার সঠিকভাবে নির্বাচিত নয়। পালিয়ে যাওয়া আশরাফ গানির সরকারও নয়। যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে গানিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছিল। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল আফগানবাসীর। প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের মানুষেরা তালেবানকে চাইতেন না ঠিকই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকেও পছন্দ করতেন না। তার কারণ, আফগানিস্তান জুড়ে যুকতরাষ্ট্রের ক্রমাগত অত্যাচার। রেডক্রসের হাসপাতালও ধ্বংস হয়েছে দেশটির হামলায়। অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে যুকত্রাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে। যে ঘটনাগুলি কখনওই সামনে আসেনি। এমনকি, আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসে থাকা সরকারও এ সমস্যাগুলোকে কখনও সমাধানের চেষ্টা করেনি। করবেই বা কী করে! কারণ ওদের হাত-পা বাঁধা। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহাযতায় ওরা ক্ষমতায় বসে আছে। সেই ক্ষমতায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া তো সম্ভব নয়। হামিদ কারজাই তার শাসনকালের শেষের দিকে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উল্টে তাকেই সরে যেতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তৈরি পরিস্থিতি ধীরে ধীরে তালিবানের দিকে হাওয়া ঘুরিয়ে দেয়। খুব ধীরে হলেও তা ক্রমে আমেরিকার বিরুদ্ধে গোটা আফগানিস্তানকে তাতিয়ে তোলে। তালিবানের মধ্যে একটা ‘বিপ্লবী’-সুলভ ভাবভঙ্গি আছে, যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষ সেটা আরও বেশি করে মেনে নিতে শুরু করে। কিন্তু মেনে নিলেই তো হলো না, এত বড় একটা যুদ্ধ চালাতে গেলে তো রসদ দরকার। অস্ত্র আর রসদ না থাকলে এই লড়াই সম্ভব নয়।
মহামারীর এ দু:সময়ে কে কার পাশে দাঁড়াবে? সে সময় নেই কারও। কথা হচ্ছে কী হবে সে সব মানুষের যারা দুনিয়ার সাথে চলার জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন? আফগানিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন একজন নারী। তিনি টিভিতে বলছেন, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে গিয়ে আজ তাকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে? কী এ চরম মূল্য?
তার জবাব তালেবানদের নতুন কাজেই স্পষ্ট। তারা ইতোমধ্যে পনের বছরের ওপর তরুণীদের তালিকা করার আদেশ দিয়েছে। এসব তরুণীরা হবেন তাজা ও নরম। বলাবাহুল্য এটা তাদের চাহিদা। সাথে শুরু হয়ে গেছে দেয়াল থেকে নারী ছবি থাকা যেকোনও পোস্টার বা বিলবোর্ড মোছার কাজ। নারী বিদ্বেষী তালেবানরা ১২ বছরের বড় কোন মেয়ের পড়াশোনা ও নিষিদ্ধ করে দেবে।
এ দেশটির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় অনেক শক্তিশালী দেশের হাত ছিল। আশির দশকে নূর মোহাম্মদ তারাকী ও বারবাক কারমাল ছিলেন আধুনিক কাবুলিওয়ালা। তাদের নিয়ন্ত্রণে সে দেশে সমাজতন্ত্র জাতীয় কিছু একটা হয়েই গেছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের তা সহ্য হয় নি। তারাই তালেবান বানিয়ে আফগান সে সরকার হটায় এবং দিবালোকে তাদের ফাঁসিতে ঝোলায়। ইতিহাসের সে পাপ, এখন সাপ হয়ে ফণা তুলছে।
মার্কিন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির ইতিহাস এমনই। তারা কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইরান এমনকি বাংলাদেশের বেলায়ও নিজ মিত্রকে ফেলে পালাতে বা সরে আসতে বিলম্ব করেনি। পাকিস্তান যখন বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌ বহরের আগমন ও তাদের জয় নিয়ে উত্তেজিত তখন তারা নিরবে জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছল। হাস্যকর হলেও সত্য তখন বলেছিল তারা না কি মাছ ধরতে এসেছিল এতো দূরে।
আজ কাবুলের পতন ও সেখানকার পরিস্থিতি দেখে যারা উল্লাসিত কিংবা জোশে ভুগছেন- তাদের বলি ঘর সামলান। যে দুটো রক্ষাকবচ বাংলা বাঙালিকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার একটি সংস্কতি, অন্যটি নারী শক্তি। এখন এ দুটোর প্রথমটা নির্জীব। পরেরটি নানা আক্রমণে দুর্বল। বাংলাদেশে নারীদের ওপর আক্রোশ নতুন কিছু না। তারপরও সব ষড়যন্ত্র ও দুশমনির মুখে ছাই দিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে নারী নেতৃত্বে। এ জায়গাটা সুরক্ষিত রাখতে না পারলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না।
হয়তো জেনেছেন চীন একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হবার পরও বলেছে, তারা তালেবানদের সাথে বন্ধুতা রেখে চলবে। বিস্ময়ের কিছু নাই। এর নাম রাজনীতি। পাকিস্তান-চীন মৈত্রী বলয় তালেবানদের পক্ষ নেবে। উল্টো দিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ এখন দৃশ্যত বিপক্ষে অবস্থান নিবে। চীন চাইবে না তালেবান হটুক। কারণ এখানে ধর্ম বা মৌলবাদ বিষয় না। বিষয় স্বার্থ।
দেশে সমাজে যে তালেবান ছুপা রয়েছে বা লুকিয়ে আছে, তাদের কথা সরকারি মহলও স্বীকার করে। এরা আছে, এদের সবাই চেনে। এদের চিহ্নিত করা ও আলাদা করা না হলে আমরা নিরাপদ থাকবো না।
একদা আব্দুর রহমান নামে সরল ভোলাভালা এক কাবুলির দেশ এখন আতংক ও ভয়ের ভেতর ঢুকেছে। এই ভয়-ভীতি সবদেশের সব নারীদের মনে। তাই মা-বোনদের জন্যই এর থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
আধুনিকতা, সুফিবাদ, মরমীবাদ, নারীর সম্মান ও শিক্ষার জন্য সর্তক থাকা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। এর সাথে জোশ উন্মাদনার কোন সম্পর্ক না থাকাই হবে মঙ্গলের। যদিও সরকারি দল বা বিরোধি দল এবং জনগণের ভেতরও তার উল্টো ধারাই দেখতে পাই আমরা।
কবে এবং কীভাবে সাবধান হবো আমরা?
অজয় দাশগুপ্ত
![](https://opinion.bdnews24.com/bangla/wp-content/uploads/2020/08/117347067_3473810772663530_4452836481285613556_n.jpg)
সিডনি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন