১ মার্চ, স্বাধীনতার মাসের পয়লা দিন দিনাজপুরের বিরামপুর থেকে সহকর্মী এ এস এম আলমগীরের পাঠানো খবরটি পড়ে মন খারাপ হলো। খবরটির শিরোনাম, ‘মা-বাবার ভিক্ষাবৃত্তি, ইউএনওর কাঠগড়ায় সন্তানেরা’।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সন্তানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, এ জন্য মন খারাপ হয়নি। মন খারাপ হয়েছে তাঁদের মা-বাবাদের করুণ, অসহায় ও অমর্যাদাকর জীবন দেখে। বৃহস্পতিবার বিরামপুরের ইউএনও মো. তৌহিদুর রহমান এক গণশুনানির আয়োজন করেছিলেন, যেখানে একটি ইউনিয়নের ২৫ জন বৃদ্ধ নারী ও ৪ জন পুরুষ অংশ নেন, যাঁরা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ইউনিয়নের নাম কাটলা। ওই শুনানিতে তাঁদের সন্তানদেরও হাজির করা হয়েছিল।
কেন ভিক্ষা করতে হচ্ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে একজন বৃদ্ধা বলেছেন, তাঁর তিন ছেলে। তিন ছেলেই বিভিন্ন গ্রামে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে কোনো সন্তানই তাঁকে কাছে রাখেননি। বাধ্য হয়ে অন্যের জায়গায় থাকেন; জীবন চালান ভিক্ষাবৃত্তি করে। তাঁর ভাষায়, ‘ছলের (ছেলের) বউরা কেউ দেখপা পারে না বা (বাবা)। ওমার (তাদের) অত্যাচারে হামাক আলাদা করে দিছে। ছলগুলা কেউ খাওন-পরোন দেয় না। তাই এই বুড়া বয়সেও ভিক্ষা করবা নাগে।’
আরেকজন মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ‘খায়ে না খেয়ে চার ছলেক বড় করিছি। চার ছলের মধ্যে তিন ছল ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। আরেক ছল ঢাকায় চালায় রিকশা। বড় ছলের মেয়ের বিয়ের সময় হামার ভাগের জমি নিয়া বিক্রি করে দিছে। তা-ও ছলের কাছে হামার ঠাঁই হলো না।’ ভাতিজার দেওয়া একটি ভাঙাচোরা ঘরে কোনোরকমে ঠাঁই পেয়েছেন এই নারী। জীবন বাঁচাতে তাঁকেও ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিতে হয়েছে।
Eprothom Aloহরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাসেমও (৭৩) অংশ নিয়েছিলেন ওই শুনানিতে। তিনি ছিলেন গ্রাম পুলিশ। তাঁর সুবাদেই ছেলে নবাব আলী গ্রাম পুলিশের চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু এখন ছেলে বৃদ্ধ বাবাকে দেখছেন না। জীবনের ঘানি টানতে বাবাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয়েছে।
শুনানিতে আসা সন্তানদের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন তাঁরা বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিচ্ছেন না। কেউ জবাব দিতে পারেননি। কী জবাব দেবেন, যে বাবা-মা তাঁদের লালনপালন করেছেন, বড় হয়ে তাঁদেরই ভুলে গেছেন। এর চেয়ে নির্দয় আচরণ আর কী হতে পারে?
সন্তানদের কাছে ইউএনও জানতে চান, মা-বাবার খাবার, চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক খরচের জন্য মাসে কত টাকা প্রয়োজন। সন্তানেরা খরচের একটি হিসাব দেন। এরপর ইউএনও উপস্থিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ওই মা-বাবাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিস্তিতে কিছু ভ্যানগাড়ি কিনে দেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি।
ইউএনওর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহ মহৎ ও ব্যতিক্রমী। এ জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর এলাকায় বেশ সাড়া পড়েছে। বিবিসির পক্ষ থেকে ওই ইউএনওর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। চারদিকে নানা হতাশা ও অনাচারের মধ্যেও এই ছোট্ট খবরটি মনে আশা জাগায়। আমাদের প্রশাসনে এ রকম মানুষ এখনো আছেন, যিনি প্রমাণ দিয়েছেন, প্রশাসন মানুষের জন্য। তৃণমূলের সব প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি যদি এভাবে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করতেন, সহজে অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত।
বিরামপুর উপজেলায় যাতে কাউকে ভিক্ষা করতে না হয়, সে জন্য যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থান করে দেওয়ার কথা বলেছেন ইউএনও। আর যাঁদের কাজ করার সামর্থ্য নেই, তাঁদের সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং বেসরকারি সহায়তার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি গণশুনানিতে অংশ নেওয়া সন্তানদের কাছ থেকেও প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন, তাঁরা বাবা-মাকে ভিক্ষা করতে দেবেন না।
এই ঘটনা আমাদের সামনে একটি কঠিন সত্য তুলে ধরছে। মা-বাবার প্রতি সন্তানদের যে দায়িত্ব, সেটি অনেকেই পালন করেন না। শুধু বিরামপুরের দরিদ্র কৃষক বা মজুর শ্রেণির মানুষ নয়; বড় বড় শহরের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সামর্থ্য থাকতেও মা-বাবাকে দেখেন না। বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের আশ্রমে বা নিঃসঙ্গ পরিবেশে কাটাতে হয়। কয়েক মাস আগে একজন সাবেক কূটনীতিক তাঁর বাবার করুণ কাহিনি তুলে ধরেছিলেন প্রথম আলোর কলামে, যদিও ওই ভদ্রলোকের আর্থিক কোনো সমস্যা ছিল না। গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে যাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে গিয়েছেন। আমাদের সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে।
বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অবহেলা যেমন অমার্জনীয়, তেমনি আইনত দণ্ডনীয়। পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন নামে ২০১৩ সালে যে আইনটি সংসদে পাস হয়েছে, তাতে প্রত্যেক সন্তানকে তাঁর পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ভরণপোষণ বলতে খাওয়াদাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদানকে বোঝানো হয়েছে। এ আইনে সন্তান বলতে সক্ষম ও সামর্থ্যবান ছেলে ও কন্যা উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। আইনে উল্লেখ আছে, ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করিবার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করিতে হইবে।’ এতে আরও বলা হয়, ‘কোনো সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার, বা ক্ষেত্রমত, তাহাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস বা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করিবে না।’
ইউএনও তৌহিদুর রহমান বিরামপুরকে ভিক্ষুকমুক্ত করার ঘোষণাও দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটির সঙ্গে যে আর্থসামাজিক ব্যাধি জেঁকে বসেছে, সেটি দূর করতে না পারলে এ রকম বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ বা ঘোষণায় ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হবে না। ঢাকা শহরেও অনেক এলাকায় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বলা হয় ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা।’ কিন্তু বাস্তব কারণেই সেসব স্থান থেকে ভিক্ষুকদের বিতাড়ন করা সম্ভব হয় না।
যে মানুষটি সামর্থ্য থাকতে দেশের অর্থনীতির চাকা এগিয়ে নিয়েছেন, তিনি যে পেশায়ই নিয়োজিত থাকুন না কেন, শেষ বয়সে তাঁর বিষয়ে রাষ্ট্র উদাসীন থাকতে পারে না। মনে রাখতে হবে, কেউ স্বেচ্ছায় ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেন না। যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় প্রতিটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা না যায়, যদি সব কর্মসূচির লক্ষ্য থাকে কতিপয় মানুষের কল্যাণ ও উন্নতি, তাহলে কখনোই দারিদ্র্য দূর হবে না। বন্ধ হবে না ভিক্ষাবৃত্তিও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী ২০১৮ সালে দারিদ্র্য ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আর অতি দারিদ্র্যের হার নেমেছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে। এর অর্থ হলো এখনো ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। আর অতি দরিদ্রের সংখ্যা দুই কোটির বেশি। অর্থাৎ এরা জীবনের মৌলিক ও মানবিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত।
১৯৭১ সালে যে মানবিক মর্যাদাশীল রাষ্ট্র এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছিল, আমরা তার থেকে অনেক অনেক দূরে।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও যে বাংলাদেশ সবার ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিরামপুরের ওই বৃদ্ধ নারী-পুরুষেরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিলেন। এটি বিরামপুরের বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে হয়তো সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম বা উপজেলার চিত্র প্রায় একই রকম। আমরা যে হারে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছি, বৈষম্যের মাত্রা তার চেয়ে অনেক বেশি। একদিকে বাংলাদেশ দ্রুত ধনী হওয়ার রেকর্ড গড়েছে, অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি যে পাঁচটি দেশে গরিব মানুষের বাস, সেই তালিকায় তার নাম রয়েছে।
বিরামপুরের গণশুনানিতে অংশ নেওয়া হতভাগ্য বৃদ্ধ নারী-পুরুষেরা শুধু সন্তানের অবহেলা নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থারও চরম বৈষম্যের শিকার। তাহলে কতটা এগোল বাংলাদেশ?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন