রংপুর জিলা স্কুলে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, আজহার স্যার। তিনি বলতেন, ‘অতিরিক্ত কথা ও কাজ বিপদ ডাকিয়া আনে।’ তাঁর এই বাণী-চিরন্তনীর চিরন্তনতা প্রমাণ করতে তিনি দেরিও করতেন না। ক্লাসে কেউ কথা বললে বা নড়াচড়া করলে তিনি একই সঙ্গে দুই হাত দিয়ে অপগন্ড শিক্ষার্থীর দুই গণ্ডদেশে চড় মারতেন, এক ঢিলে দুই পাখি মারতে তাঁকে ছাড়া আমি আর কাউকে দেখিনি। চপেটাঘাতের সঙ্গে বর্ষিত হতো উপদেশের সেই মুষলও, ‘অতিরিক্ত কথা ও কাজ বিপদ ডাকিয়া আনে।’
আমাদের এক বন্ধু আছেন। তিনি ঘটনা ঘটার আগেই রিঅ্যাকশন বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রথমে তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ‘আম্মা গো, খাইছে গো।’ আমরা সবাই তাঁর দিকে দৌড়ে এসে বলি, কী হয়েছে, কী হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজ শুক্রবার।’
হ্যাঁ।
তার মানে কাইলকা শনিবার।
হ্যাঁ।
তার মানে গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল।
হ্যাঁ।
শুক্রবার আইসা গেছে, আমারে আগে কইবেন না? তার মানে তো কাইলকা শনিবার।
বিশাল খবর জানলাম আমরা। আজ শুক্রবার, তার মানে কাল শনিবার। পরশু রোববার।
ঘটনার আগে প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক নয়। আহা, গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচটায় মুশফিকুর রহিম একটা চার মেরেই উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফেললেন। খেলা জিতে গেছেন। খেলা তো তখনো শেষ হয়নি। পরপর দুই বলে দুই ব্যাটসম্যান আউট। ওই খেলা হারা সত্যি কঠিন ছিল।
এবারও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্টে মেহেদী হাসান মিরাজ শেষবার ব্যাটটা হাঁকালেন, রান শেষ করার আগেই মুশফিক উদ্যাপন করা শুরু করেছেন, বলটা কি সীমাছাড়া হয়েছিল, টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখাচ্ছিল না, ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। তবে ওটা মেঘে রবিরাগই ছিল, আগুন ছিল না। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পেরেছিল...
তো বলবার কথাটা হলো, ঘটনা ঘটার আগেই আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করি। অতিরিক্ত কথা বলে ফেলি এবং কথা বলাকেই যথেষ্ট কাজ বলে বিবেচনা করে নিশ্চেষ্ট থাকি। এ আমাদের বহুদিনের স্বভাব।
একবার একটা রাজনৈতিক দল এই রকম একটা গুজবের ভিত্তিতে একজনের মৃত্যুর জন্য শোকবাণী পাঠিয়ে দিল সংবাদমাধ্যমে। পরে শোনা গেল, তিনি মারা যাননি। পরে আরেকটা বিবৃতিতে শোকবাণীর জন্য শোক প্রকাশ করতে হয়েছে।
সচিত্র সন্ধানী নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। তাতে একটা বিভাগ ছিল, এই সপ্তাহ, কুড়ি বছর আগে। পুরোনো সংবাদপত্র দেখে ২০ বছর আগের খবর ছাপিয়ে দিত তারা। সেই রকম একটা খবর ছাপা হয়েছিল, অমুক নদীতে মাছ মারা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিবাদ পাঠাল, অমুক নদীতে মোটেই মাছ মারা যাচ্ছে না। সন্ধানী কর্তৃপক্ষ বলল, ‘আমরা কুড়ি বছর আগের কথা লিখেছিলাম। এই সপ্তাহের কথা লিখিনি।’
ফেসবুক পুরো জাতিকেই যেন প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে ফেলেছে। মানে যারা ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি আর কি। সত্যাসত্য যাচাই করি না। কোনো একটা কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্ট্যাটাস লিখে ফেলি। লিখতেই হবে। না লিখলে তারও প্রতিক্রিয়া শুনতে হয়। লিখলেও শুনতে হয়। ধরুন, লিখলাম, শান্তিনগর মোড়ে জলাবদ্ধতা কি কোনো দিনও দূর হবে না?
সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসবে প্রতিক্রিয়া বা কমেন্টসের স্রোত—
শান্তিনগর মোড়ে জলাবদ্ধতা নিয়ে বললেন, হাওর নিয়ে তো কিছু বললেন না!
শান্তিনগর মোড়ে জলাবদ্ধতা বিগত সরকারের আমলেও ছিল, তখন তো কিছু লেখেননি।
রাজধানী নিয়েই তো লিখবেন, গ্রাম–বাংলার জনগণের দুঃখকষ্ট নিয়ে তো কিছু লিখলেন না।
সিরিয়ার শিশুদের নিয়ে কবে লিখবেন?
উত্তর কোরিয়া কি পারমাণবিক যুদ্ধ লাগিয়ে দেবে?
এবার হাওর এলাকায় যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। বন্যার সঙ্গে বসবাস করেই আমরা হাজার বছর ধরে আছি। কিন্তু তাই বলে বন্যায় এত মাছ মারা যাবে কেন? এত হাঁস মারা যাবে কেন?
আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল নদীর ওপরে। বন্যা হলে আমাদের উঠানে পানি উঠত। আমরা ভেলা নিয়ে, নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে গিয়ে মাছ ধরতাম। বন্যা হলে মাছ পাওয়া যাবে, এটাই আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা। মাছ মারা যাবে, এটা আমি স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছি না।
আমি প্রতিটা কাগজে একটা জিনিসই খোঁজার চেষ্টা করছি, হাওরে মাছ-হাঁস ইত্যাদির মড়কের কারণ কী।
কোনো কোনো কাগজে লিখে ফেলা হলো, আসামে ইউরেনিয়াম খনির দূষণের কারণে এই প্রাণীমড়ক। শুনে শিউরে উঠলাম। হাওর কথাটা নাকি এসেছে সাগর থেকে। আসুক বা না আসুক, হাওর এলাকায় কূল নাই, কিনার নাই, পাড়িবিহীন দরিয়ায় অসীম জলরাশি প্রায় সাগরতুল্য। সেটা দূষিত করতে কত ইউরেনিয়াম বা অন্য দূষণকারী খনিজ বা রাসায়নিক লাগবে? এ কি একটা পুকুর? একটা নদী? এ যে হাওর। আর ইউরেনিয়াম যদি মাত্রাতিরিক্ত থাকেই, তার প্রতিক্রিয়া শরীরে পড়বে ১০ বছর পরে, ১৫ বছর পরে। বেধড়ক মাছ মারা যাবে কেন? ব্যাপারটা বুঝতে হলে দরকার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান।
কিছু বোঝার আগেই প্রতিক্রিয়া। ইউরেনিয়াম আছে। ইউরেনিয়াম নাই। ইউরেনিয়ামের কথা বলি নাই, ইউরেনিয়াম খনির কথা বলেছি। ওপেন পিট মাইনিং। বন্যার সময় মাছ মারা যায়ই। ওরে, কত কথা বলে রে। কথা কম বলে আগে কাজটা করলে হয় না? বিজ্ঞানীদের, বিশেষজ্ঞদের নিয়োজিত করা যায় না আসল কারণ বের করতে। (প্রথম আলোয় প্রকাশিত বিশেষজ্ঞ মতটাকে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে—ধানগাছ তলিয়ে পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় মাছের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু হাঁস মারা যাবে কেন? অবশ্য আদৌ কটা হাঁস কোনখানে কীভাবে মারা গেছে, ভালোভাবে না দেখেশুনে এই প্রশ্নও বোধ হয় করা ঠিক নয়। কিন্তু একটা কথা বারবার করে বলব, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ নির্ণয় করুন। তার আগে কী ঘটেছে, তা কারোরই বাতলে দেওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তো বলা উচিতই নয়।)
যাক, তবু দুর্গত হাওর এলাকায় মাছ ধরার অনুমতি মিলেছে। ফসল-হারানো মানুষেরা অন্তত মাছ ধরে চলতে পারবে। সরকারও তাদের চাল ও অন্যান্য সাহায্য দেওয়ার কর্মসূচি দিয়েছে। একজন লিখেছেন, সমস্যা হচ্ছে মধ্যবিত্তের। তাঁরা হাত পাততেও পারছেন না, আবার সর্বস্ব হারিয়ে কী করবেন, তা-ও বুঝছেন না। খবরে দেখলাম, ব্র্যাকও ওই এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবু সুনামগঞ্জের খোলাবাজারে চাল বিক্রির লাইনে দুই শ জনের জায়গায় হাজার মানুষ দাঁড়ানো—এই খবর পড়ে বুকের ওপর পাথরের চাপ অনুভব করছি। প্রয়োজনের তুলনায় উদ্যোগ ও বরাদ্দ অপ্রতুল।
স্ট্যাটাস লিখে স্ট্যাটাস না বাড়িয়ে কাজের কাজ কি কিছু করা যায়?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন