উদ্বিগ্ন ভারতের গঠনমূলক সহযোগিতা প্রত্যাশিত
25 June 2016, Saturday
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার হার্দিক সম্পর্ককে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে বিজেপির রাজ্য নির্বাহী কমিটি নিন্দা জানিয়েছে এবং এজন্য বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দায়ী করেছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন পরিদর্শন করেছেন এবং গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের রক্ষার ব্যাপারে সরকারি দায়িত্বের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন।
আমাদের অভিমত হচ্ছে, আমরা যে ধরনের জঙ্গিবাদী সংকট মোকাবেলা করছি তার চরিত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন হাইকমিশনার শ্রিংলা। অর্থাৎ সরকারের দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়া।
আমাদের জনগণ সাম্প্রদায়িকতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন; কিন্তু একটি উৎসাহী মহল রয়েছে যারা সাম্প্রদায়িকতাকেই বাংলাদেশের একমাত্র গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখে থাকেন এবং তাদের চোখে আর কোনো ভুল-ভ্রান্তি বা ব্যর্থতা ধরা পড়ে না। রাজনীতি ক্ষেত্রে তাদের সত্তা তেমন দৃশ্যমান নয়; কিন্তু তাদের গণতন্ত্রবিরোধী একটা রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে। এরাই সরকারকে বিপথগামী করছে, এরাই যত নষ্টের মূল। এরাই জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে চলছে। জনগণের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার কোনোটাই তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদের কাজ আমাদের জনগণকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে নিন্দা করা। যেটা আমাদের জনগণের একেবারেই প্রাপ্য নয়।
তাদের ক্ষমতার লোভ আছে কিন্তু জনসমর্থন নেই। অন্য কারও কাঁধে ভর করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সমগ্র জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করে তারা মারাত্মক ভুল করছে, এটাই আমাদের উপলব্ধি। সাম্প্রদায়িকতার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদকে সহজে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা তাদের উদ্ভট চিন্তার ফসল।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত ব্যবস্থাবলীকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন এবং ৩ হাজার লোককে গ্রেফতার করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন।
এ পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি লোককে জেলে পাঠানো হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই তরুণ। গুরুত্বসহকারে অনুসন্ধান ব্যতিরেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই নির্বিচারে গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়েছে। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গণগ্রেফতারের সিদ্ধান্তটি ছিল রাজনৈতিক; কিন্তু এর অরাজনৈতিক চিন্তাভাবনাপ্রসূত প্রয়োগ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কোনোরূপ অভিযোগ ছাড়াই হাজার হাজার লোককে জেলে আটক রাখাকে সঠিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হলে আইনের শাসন কাকে বলা হবে? ভারতে কি এটা সম্ভব?
এ ধরনের গণগ্রেফতার জঙ্গিবাদকে নিবৃত্ত করতে সহায়ক হয় না। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ জনগণের সব অংশের দায়িত্বশীল লোকেরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গণগ্রেফতারের ফলে মানবাধিকারের ব্যাপক লংঘন হয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অবাধে সংঘটিত হত্যা ও পাল্টা হত্যার সংকট মোকাবেলায় যারা সরকারকে সহায়তা করতে আগ্রহী তাদের পর্যন্ত ক্ষুব্ধ করে তোলা হয়েছে এ গণগ্রেফতার চালিয়ে। এ জঙ্গিবাদকে সংখ্যালঘুবিরোধী হিসেবে দেখাটা হবে অবাস্তব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
সুশাসন উপেক্ষা করে পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে যে অসহনশীল ক্ষমতার লড়াই চলছে, তা কোথাও শান্তি-শৃংখলার সহায়ক হয়নি।
আমরা এমন এক চরম সাংঘর্ষিক রাজনীতির মধ্যে বসবাস করছি যেখানে সাধারণ মানুষ আইনের শাসনের নিরাপত্তা ভোগ করতে পারে না। হাজার হাজার নিরপরাধ লোকের ব্যাপক গ্রেফতার থেকেই বোঝা যায় মানুষ কত অসহায়। জনগণ নিরাপত্তাহীনতার ভীতির মধ্যে রয়েছে আর প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে সরকার রয়েছে না বোঝার অন্ধকারে। পুলিশি শক্তির অপব্যবহার একদিকে পুলিশের পেশাদারিত্বের মানকে খর্ব করছে, অন্যদিকে আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাকে ক্ষুণ্ণ করছে। এভাবে কোনো সরকার দেশ শাসন করতে পারে না।
দেশে যে অস্থিরতা ও হিংসা বিরাজ করছে তার কারণগুলোর সঠিক মূল্যায়ন আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন। পরিস্থিতিকে অনেক বেশি অসহায় করে তুলেছে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। প্রকৃতপক্ষে দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক বিরোধিতা সরকার নীতিগতভাবেই বরদাশত করছে না। পার্লামেন্টের গঠন কাঠামোর দিকে তাকালেই ছবিটা স্পষ্ট বোঝা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে সরকারের অংশ হিসেবে বেছে নেয়ার বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বর্তমান সরকার। নীতি-আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ভেস্তে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না।
পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাদের ক্রসফায়ার কিলিংকে বেআইনি মনে করছে না। সরকারও তা সমর্থন করছে। আর এভাবেই সরকার বিপথগামী হচ্ছে। পুলিশ আর সুশৃংখল থাকছে না। আমাদের সরকার রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা বাদ দিয়ে আমলাতান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগের ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করে চলছে।
ঐক্য ও সহনশীলতার অবর্তমানে যে রাজনৈতিক বৈরিতা বেড়ে উঠছে তাকে উপলব্ধি ও মোকাবেলা করার জন্য সরকারের যে রাজনৈতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হয় তার ভীষণ অভাব রয়েছে। অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সরকারের পেছনে না আছে জনসমর্থনের জোর, না আছে অবাধ নির্বাচন মোকাবেলা করার আত্মবিশ্বাস। বাজে লোকদের আনুগত্য কিনতে দুর্নীতি ও ব্যাপক অর্থ উড়ানো হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, দুর্নীতি এখন পুুকুর চুরির পর্যায়ে নেই, সাগর চুরির আকার ধারণ করেছে।
একটা দৃঢ়মূল গণতান্ত্রিক জাতি হিসেবে এবং বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অবশ্যই অবগত রয়েছে বাংলাদেশ শান্তি ও শৃংখলার গুরুত্ব সম্পর্কে কতটা সচেতন। তাই বাংলাদেশের বিদ্যমান সংকট মূল্যায়নে ভারত ভুল করবে না, এটাই প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা ইস্যু। তাই রাজনৈতিক বিজ্ঞতা নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এ ইস্যুতে করণীয় ঠিক করতে হবে। ভারত নিশ্চয়ই বোঝে যে, জনজীবনে নিরাপত্তা না থাকলে পুলিশ দিয়ে কোনো গোষ্ঠীবিশেষকে বিচ্ছিন্নভাবে নিরাপত্তা দেয়া যায় না। তাই বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে প্রকৃত বন্ধুর কাজ করতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রতি আমাদের জনগণের যে গভীর অঙ্গীকার রয়েছে, তাকে এ দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বহীন বিবেচনা করে সম্প্রীতির সম্পর্ক নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করা যাবে না।
নির্বাচনবিহীন ক্ষমতার যে লড়াই বাংলাদেশে চলছে, সেখানে জনগণের না আছে সরকার পছন্দ করার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা, না আছে তাদের রাজনীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা। কতিপয় ‘বিজ্ঞ ব্যক্তি’ জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করবেন, বাংলাদেশীরা তেমন জাতি নয়। নিজেদের ভাগ্য গড়ার অযোগ্য তারা নয়। তাদের জানার অধিকার আছে এসব বিজ্ঞ ব্যক্তি কারা। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ক্ষমতার দাপট দেখানোর লোকের অভাব নেই, দায়িত্ব পালনের যোগ্য লোকের যত অভাব।
গণতন্ত্র অর্জনের মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সাহায্য করেছে। তাই ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষার ব্যাপারে বাংলাদেশকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হতে সহযোগিতা দিতে পারে না। পাকিস্তান আমলে আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সমস্যা ছিল না। পাকিস্তান ভাঙার কারণ তাই সাম্প্রদায়িকতা নয়। কিছু লোক নিজেদের বড় মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ। তারা যে জনগণের মুক্তিযুদ্ধের অংশ নন সেটা তো তারাই প্রমাণ করেছেন। তাদের কাছে গণতন্ত্র, সুশাসন বা মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কোনো গুরুত্ব নেই। শুধু কথিত ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য তারা ব্যস্ত। তারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের মুসলমান তাদের ইসলাম ধর্ম চর্চা করবে, পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেকার ঝগড়া নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না, আমরা জোর দিচ্ছি জাতীয় রাজনীতির ব্যাপারে- যা অবশ্যই গণতান্ত্রিক হতে হবে। গণতন্ত্রের বিকল্প যে জঙ্গিবাদ, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশকে জঙ্গিবাদ থেকে রক্ষার জন্যই আমরা গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। অস্ত্র শক্তি তো জঙ্গিবাদদের শক্তি। উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বাস্তবে একে অপরের সহযোগী। তাই উগ্রবাদ কোনো প্রোগ্রেসিভ রাজনীতি নয়। দেশ জনগণের, শাসনও হবে জনগণের।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন