ইইউ’র সাথে সম্পর্ক নিয়ে চীন কেন উদ্বিগ্ন?
18 October 2022, Tuesday
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক নিয়ে হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন গত সোমবার বলেছেন, ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সংযোগ এবং শক্তিশালী পরিপূরকতার সাথে চীন এবং ইউরোপ পরষ্পর প্রতিদ্বন্দ্বী নয় অংশীদার এবং উভয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা প্রতিযোগিতার চেয়ে অনেক বেশি।
ইইউ-এর পররাষ্ট্র বিষয়ক শাখা সদস্য দেশগুলোকে চীনা সরবরাহ চেইনের ওপর নির্ভরতা কমাতে পরামর্শ দিতে পারে কিনা সাংবাদিকের এমন এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াং এই মন্তব্য করেছেন। ওয়াং বলেছেন, বিশ্বব্যাপী শিল্প ও সরবরাহ চেইনের গঠন ও বিকাশ বাজার আইন এবং কর্পোরেট পছন্দের সম্মিলিত প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আরোপিত কৃত্রিম বিধিনিষেধ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিরুদ্ধে চলে এবং শিল্প ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে অস্থিতিশীল করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কোনো দেশের স্বার্থের জন্য সহায়ক নয়।
ব্রাসেলসে ইইউ রাষ্ট্রদূতদের বার্ষিক কনফারেন্স ২০২২-এ বৈদেশিক বিষয় এবং নিরাপত্তা নীতির জন্য ইইউ-এর উচ্চ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল ফন্টেলেসের সাম্প্রতিক মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে, ওয়াং উল্লেখ করেছেন যে চীনা শ্রমিকরা তাদের কম বেতনে অনেক ভাল কাজ করেছে। ইইউ এর সুবিধা পেতে পারে।
চীন-ইউরোপীয় সম্পর্ক ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর এখন বেইজিং হলো এখন ইইউ্’র বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউরোপের সাথে চীনের সম্পর্ক চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মস্কো এবং বেইজিং উভয়কেই জোটবদ্ধ হবার জন্য অভিযুক্ত করে। ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২২-তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মার্কিন সরকার তিন মাসের মধ্যে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশের বিষয়ে চীনের সাথে গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করে এবং রাশিয়াকে আক্রমণ না করতে আহ্বান জানানোর জন্য চীনকে অনুরোধ করে। আমেরিকান এ্ই অনুরোধ চীনা কর্মকর্তারা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল যে তারা মনে করে না যে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান কোন আক্রমণ হবে। নিউ ইয়র্ক টাইমস গত ২ মার্চ রিপোর্ট করেছে যে, একটি পশ্চিমা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে চীনা কর্মকর্তারা পুতিনকে ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক চীন হোস্ট করা পর্যন্ত আক্রমণ বিলম্বিত করতে বলেছিলেন। দ্য গার্ডিয়ান রিপোর্ট করেছে যে একটি সূত্র রয়টার্সকে দাবির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, কিন্তু ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাস চীনকে দোষারোপ করার জন্য এটিকে 'স্মিয়ার' হিসেবে উল্লেখ করে অস্বীকার করেছে। বিশ্লেষক রিচার্ড ম্যাকগ্রেগর লিখেছেন যে চীন "ইউক্রেনের উপর একটি পরিষ্কার বার্তার উপর মীমাংসা করার জন্য চেষ্টা করছে" কারণ এটি রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে "অসংলগ্ন পুনর্মিলন করার চেষ্টা করছে"।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেও চীন ইইউ সম্পর্ক কিছুটা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যায়। মার্চ ২০১৯ ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনকে একটি "পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী" হিসেবে উল্লেখ করে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন ঘোষণা করে যে তারা একটি বিনিয়োগ চুক্তিতে পৌঁছেছে যেটি প্রথম ২০১৩ সালে চালু হয়েছিল। এটাকে বিনিয়োগের সমন্বিত চুক্তি (সিএআই) হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ইউরোপীয় সংসদে রিপোর্ট করা হয় যে ইউরোপীয় কাউন্সিলের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা কমিটি এবং ইউরোপীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলির বিরুদ্ধে চীনের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এই চুক্তির অনুমোদনের বিষয়ে গুরুতর সন্দেহ দেখা দেবে। ২০২১ সালের মে মাসে, ইউরোপীয় কমিশন অর্থনীতির কৌশলগত ক্ষেত্রে চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করে। একই মাসে, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সিএআই-এর অনুসমর্থন বন্ধ করে দেয়। ইইউ চীনের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং অসংখ্য অ্যান্টি-ডাম্পিং ব্যবস্থা রাখে।
এত কিছুর পরও চীন- ই্ই্উ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভালোভাবে চলে আসছে।
গ্লোবাল টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে চীন ইউরোপে ২৬.৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এয়ার কন্ডিশনার এবং বৈদ্যুতিক কম্বল ইত্যাদি গরম করার সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৪১.৬ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়,চীন এবং ইইউ দেশগুলি উচ্চ অর্থনৈতিক পরিপূরকতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে, যা উভয় পক্ষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য দ্বারা প্রতিফলিত হয়েছে।
গত বছর, চীন-ইইউ বাণিজ্য প্রথমবারের মতো ৮০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মহামারী, মুদ্রাস্ফীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও এই বছর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থিতিস্থাপক হয়েছে।
চীন রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, চীন-ইউরোপ মালবাহী ট্রেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মেরুদণ্ড আর চীনের কারখানা এবং ইউরোপীয় স্টোরগুলির মধ্যে একটি শক্তিশালী চ্যানেল হয়ে উঠেছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও, ১২ হাজার আন্তঃসীমান্ত পণ্যবাহী ট্রেন বছরের এ পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে, যা আগের বছরে তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। এসময় মোট ১,১৮ মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার বহন করা হয়, যা আগের বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।
চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর বিষয়ে কিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ নিয়মিত কথা বলে আসছে। ২০২১ সালের মে মাসে, ইউরোপীয় কমিশন কৌশলগত এলাকায় চীন এবং অন্যান্য বিদেশী সরবরাহকারীদের উপর নির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনা সম্বলিত আপডেট করা শিল্প কৌশল উপস্থাপন করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্য অনুসারে বেইজিং আশা করে যে চীন-ইইউ সহযোগিতাকে যেন বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখে ইইউ যা উভয় পক্ষের সাধারণ স্বার্থ বৃদ্ধি করবে এবং বৈশ্বিক শিল্প সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।
ইউক্রেণ যুদ্ধ এবং তাইওয়ান ইস্যুকে ঘিরে সাম্প্রতিক উত্তেজনায় এই সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর দেশটির অর্থনীতি ও বাণিজ্যে বহুলাংশে বেইজিং নির্ভর হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন অভিযানকে ইউরোপ তাদের নিরাপত্তার উপর বড় রকমের রুশ আগ্রাসন হিসাবে গণ্য করে এবং এর পর রাশিয়ার উপর ব্যাপক ভিত্তিক অর্থনৈতিক বিধি নিষেধ আরোপ করে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন