|
খোরশেদ খোকন
|
|
স্মৃতির জোনাকিরা... (শৈশবের দিনগুলি-০৭)
11 September 2015, Friday
১৯৮৭ সালের শবে-বরাতের রাতটা ছিল আমার জীবনের একটি স্মরণীয় রাত।
বাবা তখন জামালপুর জেলা সদরে চাকরী করতেন। আমি তখন শহরের দয়াময়ী মোড় এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তাম। আমাদের বাসা থেকে পায়ে হাটা দূরত্বে ছিল শহরের বড় রাস্তাটা। সেই রাস্তাটার একপাশে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ আর অন্যপাশে পীর শাহ জামাল (রঃ) এর মাজার। লোকজন বলতো, পীর শাহ জামাল (রঃ) এর নামেই জামালপুর জেলার নামকরন করা হয়েছে।
কৈশোরের দিনগুলিতে আমরা বন্ধুরা মিলে মাজার এলাকায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা নানা রঙের মানুষ দেখতাম। মাজারের পাশেই ছিল জামে মসজিদ আর মসজিদের দেয়ালের ওপারেই বিশাল ঈদগাঁ ময়দান। শুক্রবারে বন্ধুরা দল বেঁধে নামাজ পড়ার মজাই ছিল অন্যরকম।
বিকেলে ঈদগাঁ ময়দানের দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠা নানা জাতের ফলের গাছে গাছে আমাদের ছিল অবাধ বিচরণ। আম, জাম, পেয়ারা, আতা, বেল, বড়ই এসব নিয়েই ছিল আমাদের নিত্যদিনের কোলাহল। গাছের একেবারে মগডালে পৌঁছে যাওয়াই ছিল সব চাইতে গর্বের বিষয়।
সেই শবে বরাতের সন্ধ্যায় একদল লোক মাজার থেকে দোয়া দুরুদ পরে রওনা হয়েছিল জামালপুর শহরের সব চাইতে বড় কবর স্থানের দিকে। আতশবাজী, মোমবাতি, আগরবাতি আর মানুষের কোলাহলে ভিড়ে আমিও বন্ধুদের সাথে দলে-মিছিলে রওনা হয়েছিলাম কবর জিয়ারত করতে। ট্রাকের উপরে দাড়িয়ে জিকির করতে করতে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম কবর স্থানে। সেখানে কবর জিয়ারত শেষে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, পরিচিত কেউ নেই!
সেদিন আশেপাশে পরিচিত কাউকে না পেয়ে, আমি ভীষণ আতংকিত হয়ে গিয়েছিলাম। আতংকের কারনগুলো ছিল (১) বাবা/মা’কে না বলে এতোদূরে আসা, (২) রাত ৯টার পরেও বাসার বাইরে থাকা (৩) বাসায় ফিরে যাবার রাস্তাটা না জানা (৪) পকেটে কোন টাকা-পয়সা না থাকা; আরও কত কি?
লোকজন আতশবাজী, মোমবাতি, আগরবাতি আর সিন্নি নিয়ে সারাটা এলাকা মাতিয়ে রেখেছিল। আমি শুন্য বুকে, অস্থির হয়ে একা একা এলোমেলো ঘুরছিলাম আর চেনা কাউকে মনে মনে খুঁজছিলাম। এমন সময় দেখি, আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন বাবা। বাবার বাইকে চেপেই সেই রাতে বাসায় ফিরেছিলাম।
সেই রাতে, বাবা আমাকে একটি রুমে বন্দী করে এমন মার মেরেছিলো...!? সে মারই ছিল আমার জীবনে সবচাইতে ভয়াবহ মার। আমার মা আর ভাই-বোনরা কান্নাকাটি করেও সে রাতে দরজাটা খুলতে পারেনি! আমি সেই মারের পরে, একটানা তিনদিন জ্বরে ভুগেছিলাম। পিঠের চামড়া উঠে গিয়েছিল কিনা, আজ আর মনে নেই!?
সেই থেকে আমার মনে হতো, আমি একদিন বাড়ী থেকে পালাবোই, পালাবো...!?
না...! আমার আর বাড়ী থেকে পালানো হয়নি...।
আজ নিজে “বাবা” হয়ে বুঝতে পারি; কতটা স্নেহ, ভালবাসা আর অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে বাবা সেদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সারাটা শহর তন্ন তন্ন করে আমাকে খুঁজেছিলেন!?
সেই রাতে বাবার চোখের স্নেহ, ভালবাসা, কিংবা অনিশ্চয়তাকে আমি দেখিনি, শুধুই দেখেছিলাম ক্রোধ।
আজ এতো বছর পর; আমি বাবার সেই সেদিনের ক্রোধ টাকে একদম ভুলে গেছি; মনের কোণে কেবলি খুঁজে পাচ্ছি সেদিনের সেই স্নেহ, ভালবাসা আর অনিশ্চয়তা...!
বাবা, “তোমার সেই সেদিনের অবাধ্য ছেলেটাকে, চিরদিনই ভালবেসে ক্ষমা করে দিও, আজ এটাই আমার প্রার্থনা।”
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন