কোরআনের গল্প :-হযরত হাতেব ইবনে আবী বালতায়া (রাঃ) ও সারা নান্মী গায়িকার ঘটনা

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:২৭:০১ সকাল



বদর যুদ্ধের পর মক্কা বিজয়ের পূর্বে মক্কার সারা নান্মী একজন গায়িকা প্রথমে মদীনায় আগমন করে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন ,তুমি কি হিজরত করে মদীনায় এসেছ? সে বললোঃ না।

আবার জিজ্ঞাসা করা হল ,তবে কি তুমি মুসলমান হয়ে এসেছ? সে এরও নেতিবাচক উত্তর দিল।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন তাহলে কি উদ্দেশ্যে আগমন করেছ? সে বললো আপনারা মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন। আপনাদের মধ্য থেকে আমি জীবিকা নির্বাহ করতাম। এখন মক্কার বড় বড় সরদাররা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং আপনারা এখানে চলে এসেছেন। ফলে আমার জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে গেছে। আমি ঘোর বিপদে পড়ে ও অভাবগ্রস্থ হয়ে আপনাদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেছি। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন তুমি মক্কার পেশাদার গায়িকা। মক্কার সেই যুবকরা কোথায় গেলো, যারা তোমার গানে মুগ্ধ হয়ে টাকা-পয়সার বৃষ্টি বর্ষণ করতো? সে বললো ,বদর যুদ্ধের পর তাদের উৎসব পর্ব ও গান-বাজনার জৌলুস খতম হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত কেউ আমাকে আমন্ত্রন জানায়নি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল মুত্তালিব বংশের লোকগণকে তাকে সাহায্য করার জন্যে উৎসাহ দিলেন। তারা তাকে নগদ টাকা-পয়সা, পোশাক-পরিচ্ছেদ ইত্যাদি দিয়ে বিদায় দিল।

এটা তখনকার কথা, যখন মক্কার কাফেররা হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে ছিল এবং রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ইচ্ছায় গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার আন্তরিক আকাঙ্খা ছিল যে, এই গোপন তথ্য পূর্বা‎েহ্ন মক্কাবাসীদের কাছে ফাঁস না হোক।

এদিকে সর্ব প্রথম হিজরতকারীদের মধ্যে একজন সাহাবী ছিলেন হাতেব ইবনে আবী বালতায়া (রাঃ)। তিনি ছিলেন ইয়েমেনী বংশোদ্ভূত এবং মক্কায় এসে বসবাস অবলম্বন করেছিলেন। মক্কায় তার স্বগোত্র বলতে কেউ ছিলনা। মক্কায় বসবাস কালেই মুসলমান হয়ে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানগণ তখনও মক্কায় ছিল। রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অনেক সাহাবীগণ হিজরতের পর মক্কায় বসবাসকারী মুসলমানদের উপর কাফেররা নির্যাতন চালাত এবং তাদেরকে উত্যক্ত করতো। যে সব মুহাজিরের আত্বীয়-স্বজন মক্কায় ছিল, তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা কোন রূপে নিরাপদে ছিল। হাতেব ইবনে আবী বালতায়াতা চিন্তা করলেন যে, তাঁর সন্তান-সন্ততিকে শত্রুর নির্যাতন থেকে বাঁচিয়ে রাখার কেউ নেই। অতএব মক্কাবাসীদের প্রতি কিছু অনুগ্রহ প্রদর্শন করলে তারা হয়তো তার সন্তানদের উপর জুলুম করবেনা। তাই গায়িকার মক্কা গমনকে তিনি একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহন করলেন।

হাতেব স্বস্থানে নিশ্চিত বিশ্বাসী ছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আল্লাহ্ তায়ালা বিজয় দান করবেন। এই তথ্য ফাঁস করে দিলে তার কিংবা ইসলামের কোন ক্ষতি হবেনা। তিনি ভাবলেন, আমি যদি পত্র লিখে মক্কার কাফেরদেরকে জানিয়ে দেই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার ইচ্ছা রাখেন, তবে আমার ছেলে-মেয়েদের হেফাজত হয়ে যাবে। সুতরাং হাতেব এই ভুলটি করে ফেললেন এবং মক্কাবাসীদের নামে একটি পত্র লিখে গায়িকা সারার হাতে সোপর্দ করলেন।

এদিকে রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে ব্যাপারটি জানিয়ে দিলেন। তিনি আরও জানতে পারলেন যে, মহিলাটি এসময়ে রওযায়ে খাক নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

বোখারী ও মুসলিম গ্রন্থে হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে, আবু মুরসাদকে ও যুবায়ের ইবনে আওয়ামকে আদেশ দিলেন, অশ্বে আরোহণ করে সেই মহিলার পশ্চাদ্ধাবন কর। তোমরা তাকে রওযায়ে খাকে পাবে। তার সাথে মক্কাবাসীদের নামে হাতেব ইবনে বালতায়ার পত্র আছে। তাকে পাকড়াও করে পত্রটি ফিরিয়ে নিয়ে আস। হযরত আলী (রাঃ) বলেন আমরা নির্দেশমত দ্রুতগতিতে তার পশ্চাদ্ধাবন করলাম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেস্থানের কথা বলেছিলেন, ঠিক সে স্থানেই আমরা তাকে উটে সওয়ার হয়ে যেতে দেখলাম এবং তাকে পাকড়াও করলাম। আমরা বললাম পত্রটি বের কর। সে বলল আমার কাছে কারও কোন পত্র নেই।

আমরা তার উটকে বসিয়ে দিলাম। এর পর তালাশ করে কোন চিঠি পেলাম না। আমরা মনে মনে বললাম রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সংবাদ ভ্রান্ত হতে পারেনা। নিশ্চয়ই সে পত্রটি কোথাও গোপন করেছে। এবার আমরা তাকে বললাম হয় পত্র বের কর, না হয় আমরা তোমাকে বিবস্ত্র করে দিব।

অগত্যা সে নিরুপায় হয়ে পায়জামার ভিতর থেকে পত্র বের করে দিল। আমরা পত্র নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর কাছে চলে এলাম। হযরত ওমর (রাঃ) ঘটনা শুনা মাত্রই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে আরজ করলেন এই ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও সকল মুসলমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে আমাদের গোপন তথ্য কাফেরদের কাছে লিখে পাঠিয়েছে। অতএব, অনুমতি দিন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হাতেবকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলেন তোমাকে এই কান্ড করতে কিসে উদ্বুদ্ধ করলো? হাতেব আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ্ আমার ঈমানে এখনও কোন তফাৎ হয়নি। ব্যাপার এই যে, আমি ভাবলাম, আমি যদি মক্কাবাসীদের প্রতি একটু অনুগ্রহ প্রদর্শন করি তবে তারা আমার বাচ্চাদের কোন ক্ষতি করবে না। আমি ব্যতিত অন্য কোন মুহাজির এরূপ নেই, যার স্বগোত্রের লোক মক্কায় বিদ্যমান নেই। তাদের স্বগোত্রীয়রা তাদের পরিবার-পরিজনের হেফাজত করে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতেবের জবানবন্দি শুনে বললেন সে সত্য বলেছে। অতএব, তার ব্যাপারে তোমরা ভাল ছাড়া মন্দ বলো না।

হজরত ওমর (রাঃ) ঈমানের জোশে নিজ বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন এবং তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন সে কি বদর যোদ্ধাদের একজন নয় ? আল্লাহ তায়ালা বদর যোদ্ধাদের কে ক্ষমা করার ও তাদের জন্যে জান্নাতের ঘোষনা দিয়েছেন। একথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) অশ্রুবিগলিত কন্ঠে আরয করলেন আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলই আসল সত্য জানেন। -(ইবনে কাছীর)

কোন কোন রেওয়ায়েতে হাতেবের এ উক্তিও বর্ণিত আছে যে আমি এ কাজ ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্যে করিনি। কেননা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-ই বিজয়ী হবেন। মক্কাবাসীরা জেনে গেলেও তাতে কোন ক্ষতি হবে না।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা মুমতাতিনার শুরু ভাগের আয়াত সমূহ অবতীর্ণ হয়। এসব আয়াত উপরোক্ত ঘটনার জন্যে হুশিয়ার করা হয়। এবং কাফেরদের সাথে মুসলমানদের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক রাখা হারাম সাব্যস্ত করা হয়।

বিষয়: বিবিধ

১৪০৪ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348756
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:৪৪
মোঃজুলফিকার আলী লিখেছেন : অনেক সুন্দর লিখেছেন। ধন্যবাদ।
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:২৫
289489
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
348757
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:৫৩
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

হাতেব ইবনে বালতায়া রাঃএর অনুরুপ চিন্তার মানুষে আমাদের সমাজ ভরপূর হয়ে আছে! কিন্তু আমরা অনেকেই তাদের পাশে দাঁড়ানোর হিম্মত ও যোগ্যতা রাখিনা! বরং তাদের সদিচ্ছার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করি, উগ্র কটূক্তি করি!

অথচ ঈমানের দুর্বলতার জায়গাটুকুতে সাহস যোগানোর কাজটি যথাযথভাবে করলে তাঁরাই হয়ে উঠতে পারেন ময়দানের লড়াকু সৈনিক!!

জাযাকাল্লাহ..
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:২৫
289488
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : ১০০% আপনার সাথে একমত
কিন্তু আমরা যে ময়দানে দাড়াতেই পারছিনা ভাই শক্তগুলাকেই বন্দুকের গুলিতে ঝাঝরা করছে মস্তানের মতো পুলিশবাহীনি পিটাচ্ছে গুমকরছে রিমান্ডের নামে শাররীক ও মানসিকভাবে নিপিড়ন চালাচ্ছে এমন অবস্থায় কি করে দুর্বলদের সহযুগিতা করব !
ইনশাআল্লাহ আশা করি আল্লাহর মদদ খুব নিকটে কারন এখন ঘোর অন্ধকারতো তাতেই বলা যাচ্ছে আমাদের বিজয় নিকটে
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
০৭ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:৩০
289531
আবু সাইফ লিখেছেন : আমাদের কর্তব হলো কাজগুলো সঠিকভাবে করে যাওয়া

আল্লাহ যেভাবে চান তাঁর বান্দাকে সম্মানিত ও পুরস্কৃত করেন!
348768
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:৩১
আবু জান্নাত লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইর
অনেক ভালো লাগলো।
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:৩৪
289508
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
348776
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:২১
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ভাল লাগল। কুরআন-হাদীসের এ ধরনের গল্প আরো পোস্ট করুন.. অনেক ধন্যবাদ
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:৪৩
289524
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
348798
০৭ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:০২
রফিক ফয়েজী লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৭ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৫:১৭
289527
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
348826
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৮
মনসুর লিখেছেন : মাশাআল্লাহ, সুন্দর লিখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, জাজাকাল্লাহু খাইরান। শুভেচ্ছান্তে ধন্যবাদ।
ইসলামের ইতিবাচক দিক তুলে ধরে, এ ধরনের গল্প আরো পোস্ট করুন।
মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:৪৬
289551
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আমিন
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
348852
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:২২
শেখের পোলা লিখেছেন : এতে আমাদের ইমান বৃদ্ধি পাবে৷ এমন আরও লিখুন৷ ধন্যবাদ৷
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:৪৬
289552
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন মুন্সি লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File