ঘুষ যদি বৈধ হয় তবে অবৈধ কি ?

লিখেছেন লিখেছেন রাজু আহমেদ ০৭ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:৩৩:৪৯ সকাল

যেখানে মানুষের বসবাস সেখানে বিশৃঙ্খলা ঘটবেই । ছোট বড় অপরাধও সংগঠিত হবে । ভালো কাজ করা যেমন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তেমন মন্দ কাজ করাও মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য । পৃথিবীতে সবাই যদি ভালো কাজ করত তবে ভালো কাজের কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকত না । এমনকি তখন ভালো কাজ মানুষের কাছে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলত । মন্দের অস্তিত্ব আছে বলেই ভালোর মূল্য আছে । মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই উচিত-অনুচিত, বৈধ-অবৈধ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য শিখতে শুরু করে । পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ধর্মই মানুষকে বৈধ-অবৈধের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয় । বাল্যকাল থেকেই মানুষ নৈতিকতা-অনৈতিকতার মাপকাঠি ধারণ করতে শিখে । সব মানুষই চায় ভালো কাজ করে সুনামের সাথে বাঁচতে । কিন্তু কখনো কখনো অনৈতিক এবং অকল্যান জেনেও মানুষ মন্দ কাজের দিকে পা বাড়ায় । বিশেষ করে এমন কিছু অন্যায় মাধ্যম আছে যেখানে কেবল নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে মূহুর্তেই যেমনি ধনবান হওয়া যায় তেমনি সমাজে মেকি সম্ভ্রান্তের মুখোশ আচ্ছাদন করে বেশ বিলাসিতার মাধ্যমেই কাটানো যায় । তবুও মানুষ চেষ্টা করে ভালোভাবে থাকতে কিংবা ভালো পথে চলতে । মানুষ যতদিন নৈতিকতার পথে চলবে ততদিন সমাজও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হবে । এতদসত্ত্বেও বহু মানুষের বিচ্যুতি হয় এবং রাষ্ট্র কিংবা ধর্ম কর্তৃক সে বিচ্যুতি রোধে আইন কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন মানতে বাধ্য করা হয় । পৃথিবীতে কোন কালেই ভালো মানুষদের জন্য আইন করা হয়নি কেননা তারা কখনো অন্যায় করে নিজের দ্বারা সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষতি সাধন করে না । যত আইন প্রবর্তিত হয়েছে তা সকল ক্ষেত্রেই দুষ্টু লোকদের অযাচিত উৎপাত বন্ধ রাখার জন্য । অন্যদিকে ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে যেমন অন্যায় ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ করে তেমনি কিভাবে মানবীয় গুনাবলীর বিকাশ সাধন করে উন্নত জীবনের সন্ধান পাওয়া যায় তার পথও বাতলে দেয় । তবুও মানুষ নিজ স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য জাতীয় কিংবা বৃহৎ স্বার্থ হুমকির মূখে ঠেলে গিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তার করে । কেউ যাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অশুভ পাঁয়তারা করতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রও আইন প্রণয়ণ ও কতগুলো পন্থায় তা বাস্তবায়ণ করতে সচেষ্ট থাকে । স্থানীয় প্রশাসনের চৌকিদার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রপতি পর‌্যন্ত সকলেই যে যার অবস্থানে অপরাধ দমনে নীতিগতভাবে দায়িত্বশীল । এ দায়িত্বশীলরা যাতে দুর্নীতি কিংবা অন্যান্য অপরাধে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে না পারে সেজন্য জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক জবাবদিহীতার পরেই নির্ভর করতে হয় ধর্মের ওপর । সকল কিছুর পরেও কিছু মানুষ অপরাধ করে এবং মাত্র গুটিকয়েক মানুষের সে অপরাধ গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত করতে যথেষ্ট । গুটি কতক মানুষের অবৈধ উৎপাতকে দমন করার জন্য জনগন কিছু মানুষকে তাদের পাহাড়াদার নিযুক্ত করে । তবে যখন সে পাহাড়াদারেরাই রক্ষক হয়ে যখন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে তখন সে জাতির মত দূর্ভাগা জাতি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ ।

রাষ্ট্রীয় আইন কিংবা ধর্মীয় নীতি অনুযায়ী আজন্মকাল থেকে মানুষ জেনে আসছে ঘুষ প্রদান কিংবা গ্রহন অবৈধ । তবে মানুষের সে পূর্ব ধারণায় আমুল পরিবর্তনের মসলা দিয়েছেন দেশের আলোচিত-সমালোচিত বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত । বয়সে তিনি প্রবীন হলেও দেশের অর্থমন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালনে তিনি যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে । কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি এমন সব উক্তি করেন যা তার মুখ থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে স্বকর্ণে শোনার পরেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় । সদ্য বিদায়ী বছরের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম হলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারী ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ঘুষ বিষয়ক এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছেন যা দেশের প্রচলিত আইন, মানুষের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক । তিনি ঘুষকে ‘স্পিড মানি’ বা গতি সঞ্চারক অর্থ অভিহিত করে বলেন, ‘যা কোন কাজের গতি আনে, আমি মনে করি তা কোন অবৈধ বিষয় নয়, উন্নত দেশগুলোয় একে বৈধ করে দেয়া হয়েছে ভিন্ন নামে’ । তিনি এ বিষয়ে আরো বলেছেন, ‘কারো কাজ দ্রুত করে দিয়ে উপহার নিলে তা অবৈধ মনে করা হয় । কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি তা অবৈধ মনে করি না’ । অর্থমন্ত্রী এ বাক্য কোন বিবেচনায় ব্যবহার করেছেন তা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু তিনি এরকম উক্তি ব্যবহার করতে পারেন কিনা ? একটি রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে যে সকল ব্যক্তিদেরকে বিবেচনা করা হয় তার মধ্যে মন্ত্রীগণ অন্যতম । মন্ত্রীদের মধ্যেও আবার অর্থমন্ত্রীর অবস্থান শীর্ষ পর‌্যায়ে । একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ণের ভবিষ্যত নির্ভর করে অর্থ মন্ত্রনালয়ের ওপর । সেই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন শু-শিক্ষিত, স্ব-শিক্ষিত মন্ত্রী যদি এমন কথা বলেন তবে তাকে কোন মানদন্ডে পরিমাপ করা যায় ? শুধু মুসলিম ধর্মগোষ্ঠীই নয় বরং বিশ্বের সকল বিধর্মী এবং ধর্মহীন জাতি ঘুষকে চরম অপরাধ মনে করে অথচ উন্নয়শীল একটি রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী যদি ঘুষ আদান-প্রদানের ব্যাপারে কোন অন্যায় না দেখেন তবে সে জাতির চেয়ে দুর্ভাগা জাতি আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমাদের জানা নাই । মন্ত্রী পর‌্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কথা রাষ্ট্রের সাধারণ প্রজাদের জন্য আইন স্বরুপ । সেই মন্ত্রীমহোদয় যদি ঘুষকে বৈধ বলে মনে করেন তাতে তার অধিভূক্তরা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অঙ্গনে কর্মরত ব্যক্তিবর্গরা যদি মন্ত্রীর মতকে পালনীয় বলে মনে করে তবে রাষ্ট্রের পরিনতি কি হবে তা ভাবা যায় ? শুধু ঘুষের ব্যাপারেই মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় অনৈতিক উক্তি করেছেন তা নয় । দেশের আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে যখন রাষ্ট্রের চার হাজারের অধিক টাকা খোয়া গিয়েছিল তখন তিনি বেশ উচ্চস্বরেই ঘোষণা দিয়েছেলেন, এ সামান্য অঙ্কের টাকা যেতেই পারে । অর্থমন্ত্রী হয়ত ভূলে গিয়েছিলেন তিনি বাংলাদেশের মত একটি রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী । তাই তার কাছে চার হাজার কোটি টাকা কোন উল্লেখযোগ্য অঙ্কই মনে হয়নি । কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ কখনো ভূলেন যে তারা গরীব বাংলাদেশের মানুষ । চার হাজার এমনকি চার’শ টাকাও আমাদের কাছে অনেক কিছু । সাধারণ মানুষের সাথে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের উদারতায় যদি এমন বিস্তর ফারাক হয় হবে সে দেশের অবশিষ্ট শৃঙ্খলাও যে ভেঙ্গে পরবে না তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে ? মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে বহিস্কার করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবী তুলবনা কেননা বয়সে তিনি আমার বাবার চেয়েও বৃদ্ধ । তবে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর উচিত, তার অযৌক্তিক বক্তব্যের জন্য ভূল স্বীকার করে পদত্যাগ করা এবং সেটাই তার জন্য এই বয়সে মঙ্গল জনক হবে বলে বিশ্বাস ।

আরবি সাহিত্যে একটা প্রবাদ আছে, ‘ব্যক্তির কথা তার জ্ঞানের মাপকাঠি’ । শুধু অর্থমন্ত্রীর জন্যই নয় বরং দেশের সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের এ প্রবাদ বাক্যটি সর্বদা স্মরণ রাখা এবং সে অনুযায়ী বক্তব্য দেয়া কিংবা পারস্পরিক আলোচনা করা উচিত । ঘুষ কিংবা এ জাতীয় অন্যায় দেশে অহরহ হচ্ছে কিন্তু তাই বলে কি এটাকে বৈধতা দিয়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নাকি কিভাবে এ অন্যায়-অবৈধ লেনদেন বন্ধ করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক । যারা রাষ্ট্র নির্ধারিত সময উপযোগী পারিশ্রমিক পাচ্ছেন তাদেরকে ঘুষ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করা কিংবা ঘুষের ব্যাপারে এভাবে লাগাম ছাড়া কথা বলা সর্বদা রাষ্ট্রের অমঙ্গল বহন করবে । এতে ব্যক্তিত্বের যেমন ক্ষতি হবে তেমনি সরকারেরও ভাবমূর্তি অনুজ্জ্বল হবে । সাধারণ মানুষ অপরাধ করার জন্য ওঁৎপেতে থাকে আর কর্তব্যরত ব্যক্তিরা যদি তাতে উৎসাহ দেয় তবে আর কি বলার থাকে । যাদের ওপর জাতির হাল ধরার দায়িত্ব তারা যদি হাল ছেড়ে দিয়ে জাতিকে উল্টোপথে পরিচালনায় উৎসাহ জোগায় তবে সে কর্ণধারদের বিদায় করে দেয়া জাতির জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় । কাজেই দায়িত্বশীলদেরকে আরও সচেতন এবং দায়িত্ববান হওয়ার অনুরোধ থাকবে । রিকশাওয়ালার পারিশ্রমিক আর দ্রুত গতিতে কাজ করে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেলাতে যাওয়ার মত বোকামী করা অনুচিত বরং কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীদের দ্রুত কাজ করে দেয়াই দায়িত্ব । রাষ্ট্র যদি ঘুষকে বৈধ করে দেয় তবে সেখানে আর কোন অপরাধই অপরাধ বলে বিবেচ্য হওয়ার যৌক্তিতা থাকেনা । নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রী সকল অপরাধকে বৈধতা দেয়ার গুরু দায়িত্ব নিবেন না । রাষ্ট্রের আইন ও প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু বলে বা করে অযথা হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি করা কারো জন্য সমীচীন নয় ।

রাজুআহমেদ । কলামিষ্ট ।



বিষয়: বিবিধ

১০১৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

299674
০৭ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০১:৩০
লজিকাল ভাইছা লিখেছেন : ঘুষ না দেওয়া অবৈধ !!!! সংবিধান বিরোধী

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File