আপনারা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোর’আনের শাসন চান কি না? সংবাদ সম্মেলনে হেযবুত তওহীদের জবাব

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ২৬ জুন, ২০১৫, ০৩:১৮:৪৯ দুপুর

কোর’আনের শাসন চাওয়া ও না চাওয়ার বিষয়টি বর্তমান যুগের সবচেয়ে আলোচিত, বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ইসলামের কথা বললেই শুরুতেই চলে আসে কোর’আনী শাসনের কথা। তাই হেযবুত তওহীদ যখন প্রকৃত ইসলামের রূপরেখা মানুষের সামনে তুলে ধরছে তখন এ প্রশ্নটির উত্থাপন খুবই প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিসংগত। কোর’আন চাই কি চাই না এ প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয় কারণ বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি আর বর্তমান প্রচলিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক কথায় এর উত্তর দিলে তা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে এবং শ্রোতা ভুল বার্তা পাবেন।

প্রথমে আমাদেরকে কতগুলো বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা মাথায় রাখতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে কোর’আন কী? আজকে গ্রন্থাকারে যে কেতাবটি আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে বিভিন্ন বিধি বিধান সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা হঠাৎ করে আল্লাহর রসুল পান নি, এটি ২৩ বছরে একটি সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সঙ্কট, বিভিন্ন সমস্যা, বিভিন্ন প্রশ্নের আলোকে নাযেল হওয়া আল্লাহর বিধি বিধানের সমষ্টি। এই কোর’আন হুট করে নাযিল হয় নি, রসুলাল্লাহও হুট করে এটি প্রতিষ্ঠা করে শরিয়াহগুলো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন নি। আমাদের দেশের সংবিধান আজকে যে অবস্থায় এসেছে সেটা কি একদিনে এসেছে? বহু ঘটনার প্রেক্ষিতে, জাতির প্রয়োজনে সংবিধানে নতুন নতুন বিধান সংযুক্ত হয়েছে। কোর’আনটাও এভাবেই ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়েছে এবং ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই ইসলামি সভ্যতার ভিত্তি হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, একে বলা হয় তওহীদ। আজকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অধিকাংশ লোকেরাই তওহীদ কী জানে না। কলেমা তো শুধু মুখস্থ বোললেই হবে না, যিকির করলেই হবে না। এর মানে কী, তাৎপর্য্য কী, দাবি কী জানতে হবে। এটি আসলে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একটি চুক্তি যে চুক্তির উপর মানবজাতির পার্থিব জীবনের শান্তি-অশান্তি এবং পারলৌকিক জীবনের জান্নাত-জাহান্নাম নির্ভর করছে। কীভাবে? সর্বপ্রথম মানুষকে বুঝতে হবে যে, স্রষ্টার বিধান সর্বোত্তম, তাঁর চেয়ে বেশি কেউ জানে না যে কীসে মানবজাতি শান্তিতে থাকবে। এটা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বোঝার পর তাদেরকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, তাহলে আমরা আল্লাহর বিধান যে বিষয়ে আছে সে বিষয়ে নিজেরা বিধান তৈরি করব না, আল্লাহরটাই মানব। আল্লাহরটা মানার মানসিকতা আসলে তখন মানুষ দেখবে যে আল্লাহ কী বিধান দিচ্ছেন। আজ কলেমার মানে করা হয়, একমাত্র আল্লাহকেই সেজদা করতে হবে, ডাকতে হবে, তাঁরই জন্য নামাজ-রোযা করতে হবে ইত্যাদি। কলেমার এই ভুল ব্যাখ্যা মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে এ জাতির মনে মগজে গেড়ে গেছে। এই বিকৃত ইসলামে যার গুরুত্ব এক নম্বর সেটাকে একশত নম্বরে রাখা হয়েছে আর যেটার গুরুত্ব একশত নম্বর সেটাকে বানানো হয়েছে এক নম্বর। মানবদেহে নখের গুরুত্ব আর হৃৎপিণ্ডের গুরুত্ব কি সমান? ইসলামের উদ্দেশ্য শান্তি, কিন্তু দাড়ির সঙ্গে সমাজের শান্তি-নিরাপত্তার কী কোনো সম্পর্ক আছে? অথচ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানেই আগে দাড়ি প্রতিষ্ঠ, টুপি প্রতিষ্ঠা, জোব্বা আর বোরখা প্রতিষ্ঠা। ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানেই চোর-ডাকাত ধরে হাত পা কেটে দেওয়া। জেহাদ মানেই যেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, ভিন্ন সম্প্রদায়ে উপাসনালয়ে, সিনেমা হলে, আদালতে চোরাগোপ্তা বোমা মারা। ইসলাম সম্পর্কে যে সমাজে এমন কু-ধারণা, সেখানে কোর’আনের শাসন আরোপ করলেও শান্তি আসবে না। প্রতিটি কাজের একটি ধারাবাহিকতা আছে, এ ধারাবাহিকতাও একটি প্রাকৃতিক নিয়ম। এই নিয়ম না মেনে যদি গায়ের জোরে একটি দণ্ডবিধি, জীবনব্যবস্থা কোনো জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সমাজে অসন্ত্বোষ আরো বাড়বে। কারণ এ সমাজে ধর্মব্যবসায়ীদের দীর্ঘ অপপ্রচারের ফলে ইসলামের প্রকৃত ধারণাটাই বিকৃত হয়ে রয়েছে। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতার দ্বারা তাদের মন-মগজ আমূল বিবর্তিত ও প্রভাবিত। ফলে এ সমাজের মানুষগুলো ন্যায় অন্যায় বোঝে না, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য কি, ধর্ম কি, মানবজাতির প্রকৃত এবাদত কি তা বোঝে না, তারা লেবাসকেই মনে কেরে ধর্ম। আমি শুধু স্বল্পশিক্ষিত শ্রেণির কথা বলছি না, গোটা জনগোষ্ঠী যারা ইসলামপ্রিয় এবং ইসলামবিদ্বেষী সবাই ধর্ম বলতে এসব আনুষ্ঠানিকতা, লেবাস, বোরকা, অভ্যাস অনভ্যাস এবং কোর’আনের কয়েকটি আইন-কানুনকেই বোঝেন। ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থ দেওয়াকেই মুসল্লিরা সওয়াবের কাজ মনে করে। ধর্মব্যবসা অর্থাৎ নামাজ পড়ানো থেকে শুরু করে ধর্মের যে কোনো কাজ করে টাকা নেওয়া যে আল্লাহ হারাম করেছেন এটা সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ জানেনই না। সুতরাং ইসলাম প্রতিষ্ঠা বলতেই তারা বোঝেন যে ইসলামটা মোল্লাদের হাতে আছে সেটাই ক্ষমতাসীন হওয়া অর্থাৎ থিয়োক্রেসি বা মোল্লাতন্ত্র কায়েম হওয়া। এটাকে কোনোভাবেই শিক্ষিত, মুক্তমনা, সভ্য মানুষ মেনে নিতে পারে না, এটাকে ইসলাম প্রতিষ্ঠাও বলা যায় না।

আজ তারা এবাদত বলতে বোঝে মসজিদ আর খানকায় গিয়ে পড়ে থাকা, যিকির করা। এটা করে কি দেশে শান্তি আসবে না এসেছে কোনো কালে? আগে ধর্মবিশ্বাসীদেরকে বোঝাতে হবে যে এবাদত হচ্ছে এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা যে সমাজে মানুষ নিরাপদে থাকবে, পিকেটারের ইট খেয়ে হাসপাতালে যেতে হবে না, সকলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে, ডাস্টবিনে কুকুরের সঙ্গে মানুষ খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে না, কোনো নারী ধর্ষিত হবে না, কষ্টের উপার্জন ঘুষখোর বা ছিনতাইকারীর পকেটে যাবে না, বেকারত্বের গ্লানি নিয়ে কেউ আত্মহত্যা করবে না, কেউ যেন ক্ষুধায় কষ্ট পাবে না, কেউ বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরবে না। এমন সমাজ তৈরি করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করাই জেহাদ, এটাই বড় এবাদত।

বর্তমানে এদেশের পশ্চিমা জীবনব্যবস্থাকে জাতীয় জীবনব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করে তা পালন করে চলছে। আমরা মনে করি, এটা এমন একটি সিস্টেম যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা আমাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে দাসে পরিণত করার জন্য চাপিয়ে দিয়ে গেছে। সুতরাং এ সমাজের মানুষকে হুট করে কোর’আনের শাসনের কথা বলা অবান্তর ও অযৌক্তিক হবে। এজন্য আল্লাহর রসুলও তা বলেন নি। আপনি যদি রসুলের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চান, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান তবে রসুলাল্লাহ যেভাবে শুরু করেছিলেন আপনাকেও সেভাবেই শুরু করতে হবে, রসুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। কারণ তিনি হচ্ছেন উত্তম আদর্শ, উসওয়াতুল হাসানা। তিনি দাড়ি রেখেছেন বিধায় আপনিও ঐভাবে দাড়ি রাখবেন এই জন্য নয়, দাড়ি সব মানুষেরই হয়। তাই একটি নির্দিষ্ট স্টাইলের দাড়ি রাখানোর, নির্দিষ্ট পোশাক পরানোর জন্য আল্লাহ নবী পাঠিয়েছেন এমন ধারণা মুর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। তিনি দাড়ি রাখার আদর্শ নিয়ে আসেন নি, তিনি এসেছেন মানবজীবন থেকে সকল অন্যায় দূর করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে। এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি প্রথমে কী করলেন? প্রথমে তিনি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে আহ্বান জানালেন। মক্কার লোকেদের কলেমা বোঝালেন, তওহীদ বোঝালেন। মক্কার লোকেরা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পক্ষে ছিল না। তিনি প্রথমে তাদের আল্লাহর বিধান কেন মানতে হবে তা বোঝালেন, ঐক্য বোঝালেন, একক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোঝালেন। তখন তারা ধীরে ধীরে কলেমা বুঝতে পারলো তখন রসুলাল্লাহকে তাদের নেতা হিসাবে মেনে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হলো। বিচ্ছিন্ন একটি জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করলো তাঁকে কেন্দ্র করে। মক্কায় যে তের বছর ছিলেন এ দীর্ঘ সময়ে সেখানে তাঁর অনেক আনুগত্যশীল অনুসারী তৈরি হয়েছিলেন, তিনি কিন্তু ইচ্ছা করলে একটি সহিংস অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁর প্রধান বিরোধীদেরকে হত্যা করে তাঁর আদর্শকে মক্কাবাসীদের উপর চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি, কারণ অধিকাংশ লোকের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে শাসনক্ষমতা নিলেও নিরাপদ সমাজ গঠন করা যায় না। একবার মক্কার শাসন ক্ষমতা তাঁকে দেওয়ার প্রস্তাবও তাকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেটাও প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি দেখেছেন তিনি যে ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করতে চান তখনও জনগণ সেটা বোঝে নি, তারা তাদের পূর্ববর্তী জীবনবিধান বা ধারণা নিয়েই থাকতে চেয়েছে। তাই রসুল অপেক্ষা করেছেন তাঁর আদর্শটা জনগণের কাছে গৃহীত হওয়ার জন্য। এভাবে অপেক্ষা করে ১৩ বছর শুধু তওহীদের আহ্বান করে গেছেন। মক্কাবাসীকে এ কথাই বুঝিয়েছেন যে তোমরা সমস্ত ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি হিসাবে আল্লাহকে মেনে নাও। এটাই সমস্ত জীবনের মঙ্গল। কিন্তু গুটিকয় লোক বাদে সবাই প্রত্যাখ্যান করল। এরই মধ্যে মদীনাবাসীদের মধ্যে একটি বড় অংশ তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলো এবং তাঁকে নিজেদের পরিবারের মতো করে আশ্রয় দিতে সম্মত হলো। তিনি মদিনায় চলে গেলেন, কারণ সত্য প্রতিষ্ঠাই তাঁর মিশন। যারা সত্য গ্রহণে আগ্রহী তাদের কাছেই তিনি যাবেন। তখন মদিনাকেন্দ্রীক একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজব্যবস্থা কায়েম হলো। সেই ঐক্যবদ্ধ সমাজ নেতা হিসাবে রসুলাল্লাহকে মেনে নিলেন, তারা তাদের যাবতীয় সমস্যার সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে রসুলকে মেনে নিলেন। সেখানে বসবাসকারী সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে নিয়ে তিনি একটি ঐক্য ও নিরাপত্তাচুক্তি করলেন। যখন একটি জাতি রসুলাল্লাহকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হলো তারপর থেকে তাদের যাবতীয় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ একটার পর একটা বিধান নাজেল করতে থাকেন। এ বিধানগুলোর সমষ্টিই হচ্ছে আজকের কোর’আন। এখন আমাদের এ দেশের অবস্থার প্রেক্ষাপটে আপনি যদি শ্লোগান তোলেন যে আল্লাহর আইন চাই, শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন কমিটি করেন তাহলে এসব কথা হবে লোকভুলানো কথা, প্রতারণামূলক রাজনৈতিক শ্লোগান। কারণ আমাদের দেশের জনগণ ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য বোঝে না, তারা বিকৃত ইসলামকেই ধর্ম বলে মানে। সেই ধর্ম এখনো ধর্মব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত এবং জনগণ তাদেরকেই সমীহ করে চলে। ধর্মব্যবসা যে ইসলামে নিষিদ্ধ, ধর্মব্যবসায়ী আলেমরা যে আসমানের নিচে নিকৃষ্টতম জীব তা তারা জানেই না, তাই ধর্মব্যবসায়ীদেরকে তারা টাকা দিয়ে পালন করে। ঐক্যের বিরুদ্ধে কথা বলা যে কুফর সেটাও তারা জানে না, তাই তারা এখনো নিজেদেরকে শিয়া, সুন্নী, হানাফি বলে বিশ্বাস করে, নিজেদের মধ্যে ফেরকা মাজহাবের দেওয়ালকে লালন করে। এমনকি পশ্চিমাদের বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থাই সর্বোৎকৃষ্ট বলে তারা মনে করে, পশ্চিমাদেরকেই প্রভু মনে করে, সেখানে এখনই এ জাতির সামনে ‘কোর’আনের শাসন চান কি চান না’, না বলে আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে সমাজের মানুষগুলোকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝানো, ঐক্যের সুবিধা, অনৈক্যের অসুবিধাগুলো বুঝানো। তাদেরকে সর্ব উপায়ে বোঝানো যে, কোন কাজ করলে সেটা আল্লাহর এবাদত হবে, কোন কাজ আল্লাহর কাছে প্রিয়। জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে বের করে মানুষগুলোকে সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যে একটি জাতীয় ঐক্যবোধের চেতনা জাগ্রত করাই হবে আমাদের প্রথম কাজ। তারপর সমস্ত জাতি যখন এই কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হবে যে, আমরা ষোল কোটি মানুষ সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, হকের পক্ষে থাকব তখন তারা সিদ্ধান্ত নেবে যে, তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে কীসের ভিত্তিতে হবে।

সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে যারা রাতারাতি একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে চান তাদের ভুলটাও তুলে ধরতে হবে যেন কেউ সেই পথে পা না বাড়ায়। মনে রাখতে হবে, ইসলাম কেবল কয়েকটি বিধানের সমষ্টি নয়, এটি একটি সভ্যতা বা সিভিলাইজেশন যার স্থায়িত্ব হতে পারে হাজার হাজার বছর। একটি সভ্যতার সঙ্গে একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, পেশা, সামগ্রিক জীবন, শিল্প, সাহিত্য, গান, স্থাপত্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পোশাক আশাক সবকিছু জড়িত থাকে। সুতরাং একটি বই থেকে কয়েকটি আইন চালু করে দিলেই কি সেটাকে সভ্যতা বলা যাবে? যাবে না। সর্বশ্রেণির মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে না। এ কারণেই তালেবানরা রাজ্যজয় করতে পারলেও মানুষের মনজয় করতে পারে নি। যেটা রাতারাতি প্রতিষ্ঠা হয় সেটা রাতারাতি উৎখাতও হয়। রাতারাতি বিপ্লবের দ্বারা সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয় নি, বহু ঘাত প্রতিঘাত সইতে হয়েছে, বিশ্বময় এই মতবাদগুলোর ইতিবাচক নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়েছে, হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে, গণমাধ্যমে ঝড় তোলা হয়েছে। এভাবে এই আদর্শগুলো মানুষের মনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তারপর চলেছে পরীক্ষা নীরিক্ষা, সংস্কারসাধন। আদর্শ প্রতিষ্ঠার এটিই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক রীতি। যারা সহিংসতার মধ্যে দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তারা কোথাও সফল হন নি, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, এমন কি সমাজতন্ত্রের পথিকৃৎগণও তাদেরকে সমর্থন দেন নি।

আল্লাহ চান মানুষজাতি যেখানেই থাকুক ঐক্যবদ্ধ থাকুক। কারণ তিনি মানুষকে সামাজিক জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের সেই সমাজে জুলুম না থাকুক, অবাধ বাক স্বাধীনতা থাকুক, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি না থাকুক, শাসকের জবাবদিহিতা থাকুক এটাই আল্লাহ চান। আমরাও এটা চাই। আমরা মানুষকে এগুলোর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই- কারণ ঐক্যবদ্ধ না হলে এই চাওয়া কখনোই পূর্ণ হবে না। এক কথায় মানুষ ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয় তাহলেই সমাজের মধ্যে যদি শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের এই ঐক্যের মাধ্যমে ইসলামের অধিকাংশ বিধান আপনিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বাদ থাকে শুধু দণ্ডবিধি বা পিনাল কোড। সেটা জনগণই ঠিক করে নেবে যে তারা এই পিনাল কোড চায় কি চায় না। যদি তারা কোর’আনের পিনাল কোড না চায় সেটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ইসলামের নীতি বিরুদ্ধ। এমনকি আমরা এও বলছি না যে কেবল কোর’আনই স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা। যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী তারা হয়তো কোর’আনের বদলে বেদের বিধানকে উত্তম মনে করবেন, ইহুদিরা চাইবে তওরাতের বিধান। অসুবিধা নেই, ওগুলো সবই স্রষ্টারই বিধান। ওগুলো দিয়েও শান্তি এসেছে। মদীনায় ইহুদিরা কোর’আনের বিধানের বদলে তওরাতের বিধান দিয়ে নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতার দণ্ড কামনা করেছিল, কারণ সেটাকেই তারা সুবিচার বলে বিশ্বাস করত। রসুলাল্লাহ সেটা মোতাবেকই তাদের বিচার করেছিলেন। এখনো কোনো অপরাধী যদি ব্রিটিশ পিনাল কোড মোতাবেক নিজের দণ্ড চায়, তার উপর জোর করে কোর’আনের কানুন চাপিয়ে দেওয়াকে আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করি না।

তবে আমরা দ্ব্যার্থহীনভাবে বলছি যে, পশ্চিমা সভ্যতার যে জীবনব্যবস্থা মানুষকে শান্তি দিচ্ছে না, দিতে পারবে না। এগুলো প্রতারণামূলক ব্যবস্থা, এরা মানবাধিকারের কথা বলে, বাকস্বাধীনতার কথা বলে, রাষ্ট্রের কাজে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনের কথা বলে, সুবিচারের কথা বলে, সাম্যবাদের কথা বলে কিন্তু কিছুই দিতে পারে না। কিন্তু স্রষ্টার বিধানে এগুলো দেওয়া অতীতেও সম্ভব হয়েছিল, এখনও সম্ভব। এই বিশ্বাসটা আগে মানুষের মনে আমরা সৃষ্টি করতে চাই, তাহলে মানুষের সামনে কোনটা সত্য আর কোনটা প্রতারণা তা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। তখন মানুষই তার পথ বেছে নেবে। তবে আমরা মনে করি, আল্লাহর দেওয়া বিধানের চেয়ে সত্য, ন্যায়নিষ্ঠ, সুবিচারপূর্ণ কোনো বিধান হতে পারে না, তথাপি সেটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর নীতি পরিপন্থী।

বিষয়: বিবিধ

১৬১৪ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

327550
২৬ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩১
শেখের পোলা লিখেছেন : আপনার লেখাটি অত্যন্ত মুল্যবান ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে৷ এটিই সঠিক পথ৷ তবে দণ্ডবিধীতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, কারণ যখন সব কিছুই প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে তখন এটিরও আর কোরআনের বাইরে যাবার পথ থাকবে না৷ করোআন বলছে তোমরা যদি আমার কিছু অংশ মানো আর বাকী না মানো তবে দুনিয়ায় তোমরা লাঞ্ছিত হবে আর আখেরাতে থাকবে কঠিন আজাব৷ তাই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তওরাত ইঞ্জীলের ফয়সালা অচল৷ তবে রসুল সঃ তওরাতের যে বিধানকে সচল করে রেখে গেছেন তা সচলই থাকবে৷ ধন্যবাদ৷
২৭ জুন ২০১৫ রাত ১০:৪০
269988
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : কোর'আনের যে আয়াতটি আপনি উল্লেখ করেছেন সেখানে কিন্তু তওরাতের বিধান প্রসঙ্গেই বলা হচ্ছে। আসলে তওরাত বা কোর'আন দিয়ে কথা নয়, আল্লাহর বিধান দিয়ে কথা। আপনি বলেছেন, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তওরাত ইঞ্জিলের ফয়সালা অচল, কিন্তু ইসলামী শাসন বলতে আপনি কী বোঝেন? আল্লাহর রসুল ইহুদিদের বিচার করেছেন তওরাত মেনে, তার মানে কি তখন ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হয় নাই? আসলে ইসলামী শাসন মানে হলো আল্লাহর বেধে দেয়া মানদণ্ড অনুযায়ী শাসন। কোর'আন মানলে খুব ভালো, কিন্তু যদি কোনো খ্রিস্টান বা ইহুদি কোর'আন মানতে অস্বীকার করে তখন কি জোর করে তাদেরকে মানতে বাধ্য করবেন? সেটা কি ইসলামসিদ্ধ হবে? না। বরং তারা যে ধর্মগ্রন্থের ফয়সালা মেনে নেবে সেটা অনুযায়ীই তাদের ফয়সালা প্রদান করতে হবে। এটাই প্রকৃত ইসলামের নিয়ম। রসুলাল্লাহ কোথাও বলেন নি, তিনি তওরাত বা ঈঞ্জিলের বিধান রদ করেছেন, বরং তিনি সত্যায়ন করার কথাই বলেছেন। তবে ওসব প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে যেহেতু অনেক বিকৃতি ঢুকে গেছে, কাজেই এখন প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির উচিত ইসলামের সর্বশেষ সংস্করণকে মেনে নিয়ে সেই মতো চলা। এ জন্য ইহুদি-খ্রিস্টানদেরকে আহ্বান করা চলে, কিন্তু চাপিয়ে দেয়া চলে না। ধন্যবাদ।





২৮ জুন ২০১৫ সকাল ০৫:৩৪
270011
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাইজান,আল্লাহর বিধান সংষ্কার হয়েই কোরআনকে আকমালতো লাকুম দীনাকুম বলা হয়েছে৷ অতএব কোরআনের বিধানের বাইরে যাবার পথ বন্ধ৷ আর ইসলাম চাপিয়ে দেবার অনুমতি নেই, তাই বলে ইসলামী আদালতে দু ধরণের আইন থাকবে না৷ বিধর্মীদের জন্য তাদের অন্য ব্যবস্থা হয়ত হতে পারে(আমার ঠিক জানা নাই) আর ইসামী রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ ভাবে মক্কা বিজয়ের পর৷ এর পরও কি রসুল সঃ তওরাতের বিধানে ফয়সালা দিয়েছেন? আপনার জানা থাকলে জানাবেন প্লীজ৷ ধন্যবাদ৷
327556
২৬ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৫১
ইসলামী দুনিয়া লিখেছেন : আপনার লেখাটি ভালো। তবে আমার কিছু কথা আছে। ইসলাম প্রধানত দুটি অংশ-
১। ব্যাক্তিগত ইবাদত
২। হুকুমত। (আইন কানুন)
একজন মুসলিমের আগে ব্যাক্তিগত ইবাদত অতপর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার চেস্টা করা। তাই ব্যাক্তিগত ইবাদতের জন্য যা প্রয়োজন তা সবকিছুই আমল করতে হবে। তারপর সে হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে পারবে অথবা সম্বব হবে। কিন্তু বিষয়টা যদি এমন হয় যে, মুখে দাড়িই নাই , সুন্নতি পোষাকই নাই অথবা নামাজ রোজাই নাই, তাহলে তার দাড়ায় কিভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে? অতএব ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে নিজে ঠিক হতে হবে। ধন্যবাদ। ভালো থাকুন। আমার ব্লগে আমন্ত্রন।
২৭ জুন ২০১৫ রাত ১১:১৭
269990
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : ব্যক্তিগত ইবাদত ও হুকুমত নামে ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন অংশ আছে আজকে প্রথম শুনলাম। আপনি যেগুলোকে ব্যক্তিগত এবাদত বলছেন, সেগুলো আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য চরিত্র সৃষ্টিকারী উপাদান।
327594
২৭ জুন ২০১৫ রাত ০১:৪৫
মুক্ত কন্ঠ লিখেছেন : শেখের পোলা লিখেছেন : আপনার লেখাটি অত্যন্ত মুল্যবান ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে৷ এটিই সঠিক পথ৷ তবে দণ্ডবিধীতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, কারণ যখন সব কিছুই প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে তখন এটিরও আর কোরআনের বাইরে যাবার পথ থাকবে না৷ করোআন বলছে তোমরা যদি আমার কিছু অংশ মানো আর বাকী না মানো তবে দুনিয়ায় তোমরা লাঞ্ছিত হবে আর আখেরাতে থাকবে কঠিন আজাব৷ তাই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তওরাত ইঞ্জীলের ফয়সালা অচল৷ তবে রসুল সঃ তওরাতের যে বিধানকে সচল করে রেখে গেছেন তা সচলই থাকবে৷ ধন্যবাদ৷

আমিও সহমত পোষন করছি।
২৭ জুন ২০১৫ রাত ১০:৫৩
269989
মোহাম্মদ আসাদ আলী লিখেছেন : কোর'আনের যে আয়াতটি আপনি উল্লেখ করেছেন সেখানে কিন্তু তওরাতের বিধান প্রসঙ্গেই বলা হচ্ছে, কোর'আন নয়। যাদেরকে তওরাত প্রদান করা হয়েছে এবং তারা তার কিছু অংশ মেনে বাকি অংশ মানে নি তাদের জন্য আখেরাতে কঠিন আজাব অপেক্ষা করছে বলে আল্লাহ এই আয়াতে সাবধান করে দিয়েছেন। তওরাতের যদি কোনো উপযোগিতা না-ই থাকল তাহলে এই আয়াত কেন? আসলে তওরাত বা কোর'আন দিয়ে কথা নয়, আল্লাহর বিধান দিয়ে কথা। আপনি বলেছেন, ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তওরাত-ইঞ্জিলের ফয়সালা অচল। প্রশ্ন হলো ইসলামী শাসন বলতে আপনি কী বোঝেন? আল্লাহর রসুল ইহুদিদের বিচার করেছেন তওরাত মেনে, তার মানে কি তখন ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হয় নাই? প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শাসন মানে হলো আল্লাহর বেধে দেয়া মানদণ্ড অনুযায়ী শাসন। কোর'আন মানলে খুব ভালো, কিন্তু যদি কোনো খ্রিস্টান বা ইহুদি কোর'আন মানতে অস্বীকার করে তখন কি জোর করে তাদেরকে মানতে বাধ্য করবেন? সেটা কি ইসলামসিদ্ধ হবে? না। বরং তারা যে ধর্মগ্রন্থের ফয়সালা মেনে নেবে সেটা অনুযায়ীই তাদের ফয়সালা প্রদান করতে হবে। এটাই প্রকৃত ইসলামের নিয়ম। রসুলাল্লাহ কোথাও বলেন নি, তিনি তওরাত বা ঈঞ্জিলের বিধান রদ করেছেন, বরং তিনি সত্যায়ন করার কথাই বলেছেন। তবে ওসব প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে যেহেতু অনেক বিকৃতি ঢুকে গেছে, কাজেই এখন প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির উচিত ইসলামের সর্বশেষ সংস্করণকে মেনে নিয়ে সেই মতো চলা। এ জন্য ইহুদি-খ্রিস্টানদেরকে আহ্বান করা চলে, কিন্তু চাপিয়ে দেয়া চলে না। ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File