আবিরের ঘ্রাণ !!

লিখেছেন লিখেছেন Mujahid Billah ২২ মে, ২০১৭, ০৬:০৮:১৪ সন্ধ্যা

উহ্! কি উৎকট গন্ধ। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো অরিনের। সেটা অবশ্য ওই গন্ধটার জন্য নাকি তার অনুভূত দৃশ্যের জন্য তা কিন্তু জানা নেই। চারদিকে শুধু লাল লাল আবির। আর সে রঙের ছড়ানি ছিটানিতে অরিন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে, যেন নিজের অস্তিত্ব নিজের নয়। হারিয়ে যাচ্ছে সে কোনো অজানা দূরত্বে। পাশের মসজিদের আযানের ধ্বনিতে ঘুমটা কোন হাওয়ায় হারিয়ে গেলো। উহ ঘেমে গেছে অরিন এই জানুয়ারির শীতেও। ইদানিং প্রায়ই একই এই স্বপ্নটা দেখছে সে। প্রায়ই বললে ভুল হবে, বলতে হয় সবসময়। যখনই ঘুম পাচ্ছে তখনই আলতো করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে একই দৃশ্য। এই এক স্বপ্নের জন্য তার সবচাইতে প্রিয় বস্তু ঘুমটাই এখন বিস্বাদ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাও হয়ে ওঠে সবচাইতে বিরক্তিকর। তখন না যায় পালানো না যায় তাড়ানো। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে সে নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করাতে পারছে না। এটা কি করে সম্ভব, স্পপ্নে সে কিভাবে গন্ধ পাচ্ছে। নাকি খারাপ সময়গুলোতে স্বপ্নেও রংচটা রংয়ের গন্ধটাও পাওয়া যায়, যেমন অসময়ে সাদা কাপড় থেকেও রং ওঠে। বিছানা থেকে নিজেকে একরকম টেনেই তুললো সে। ঘুম জড়ানো চোখে নিজের নামে সেভ করা মায়ের নাম্বারটা ডায়াল করলো। প্রথমবার কলটা কেটে গেলে সে দ্বিতীয়বার আবার ডায়াল করলো। মা ফোনটা রিসিভ করলে সব খুলে বললো বরাবরের মত। আগেও সে অনেকবার বলেছে, যতবার স্বপ্নটা দেখেছে। ফোনটা কাটার পর হঠাৎ চিন্তা করলো ,, মা এত সকালে ঘুম থেকে কেন উঠলো? কোনো সমস্যা নয় তো! নাকি মা সবসময়ই এমন সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। জানে না অরিন। কারন কোনো দিন জানতে চেস্টাও করে নি সে। বাড়ীতে থাকতে রাতে খেয়ে যখন ঘুমাতে যেতো তখনও মা জেগে থাকতো আবার কখনো ঘুম থেকে উঠে কোনদিনও মা,কে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নি সে, অসুস্থ না হলে। কেনো এত সকাল সকাল ওঠে মা? আর একটু বেশি করে ঘুমালে কি ক্ষতি হত সংসারের? দিনভর কি কষ্ট না করে মা টা। কখনো বিনা কারণে একটু বিশ্রাম নিতে দেখেছে মাকে বলে তার মনে পরে না।

এসব সাত পাচ ভাবতে ভাবতে ব্রাশের মাথায় আলতো করে পেস্ট লাগালো সে। হয়েছেটা কি তার! আগে তো কখনো ভাবতো না সে এসব, এত্ত কিছু। নাকি এখন মা থেকে, পরিবার থেকে এতটা দূরে থাকে বলে এতটা সুগভীর চিন্তাশক্তি আসছে তার। আসলেই মানুষ আপনজন থেকে দুরে থাকলে, অপরিচিতদের মাঝে থাকলে তার চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে, নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার দ্বার উন্মোচিত হয়, বাস্তবতাটাকে বুঝতে শেখে গভীরভাবে।

ব্রাশ করে স্যুয়েটারটা গায়ে চাপিয়ে একটুক্ষন বসে থাকলো অরিন। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। অরিন রুম থেকে বেরিয়ে পরে। কোথায় যাবে সে সেটা ওর জানা না থাকলেও ওর মনের ঠিকই জানা আছে। পা চালিয়ে হেটে চলে যায় সোজা পাশের মন্দিরে। এখন মনটা যখনই খারাপ হয় তখনই সে মন্দিরে আসে সে। তার জীবনে এখন এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে সে মনখুলো সব কিছু মনে মনে হলেও বলতে থাকে। আসলেই ঈশ্বর একটা মাধ্যম বটে মনের রাগ, ক্ষোভ, যা আছে সবকিছু নিরব শ্রোতা হিসেবে শোনার। ঈশ্বর কি শুধুই কি শোনেন, নাকি তিনিও বলেন? হয়তো বলেন। যা আমাদের শোনার সাধ্যের বাইরে অথবা শুনেও না শোনার ভান করি আমরাই। এসব চিন্তা মাথায় আসাতে আজ অরিনের এখানেও বেশিক্ষন থাকা হোলো না। অপ্রাপ্ত স্বীকৃতিগুলো মানুষকে দুর্গন্ধের মত তাড়া করে, যা না চাইতেও মাথা পেতে নিতে হয়।

রাস্তায় বেরিয়ে একটুখানি পরই মনে হলো কেউ একজন তার নাম ধরে ডাকছে। পিছন ফিরে তাকলো। রিচি! নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না অরিন। হ্যাঁ, রিচিই তো! সেই একই ভঙ্গিতে গাড়ীতে হেলান দিয়ে দাড়ানো, যেভাবে সে সচরাচর সবসময়ই দাড়াতো। ঠোটযুগলে লেগে আছে সেই মন ভালো করার এক চিলতে রহস্যময়ী হাসি। পরিবর্তন শুধুর হাতের ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটায়। যেটা আগে ওর পছন্দমত সাদা রঙের ছিলো আজ ওটা অন্য কারও পছন্দমত বেগুনি রঙের। অবশ্য সেটা কেনো তা অরিন জানে। যে যেটুকুতে ভালো থাকে, সুখে থাকে পারলেও তাকে তার থেকে বেশি দিতে নেই এমন কি ছিনিয়েও নিতে নেই, এটা রিচিরই একটা কথা। টানা তিন বছর পর রিচিকে দেখছে অরিন। অরিন ছিলো রিচির সবথেকে কাছের বন্ধু। অবশ্য রিচিও ছিলো অরিনের সেই একই অনুপাতের কাছের বান্ধবী। হেটে গিয়ে রিচির সামনে দাড়ালো অরিন। কেমন আছো? প্রশ্নটা রিচিই করলো। অরিন উত্তর করলো :

- ভালো আছি। তোমার খবর কি?

- আমি ভালোই আছি অন্তত তোমার থেকে। তিন বছর পরেও আজ মিথ্যাটা না বললেই পারতে।

- মিথ্যা তো বলি না। জানোই যখন জিজ্ঞাসা না করলেও চলতো। তুমি এখানে কি করে?

- প্রায়ই এই রাস্তা দিয়েই দাদুবাড়িতে যাই। আর এই মন্দিরটায় থামি কারন মন্দিরটা কেনো জানি না আমার খুব প্রিয়, হয়তো তোমার মত কেউ এই মন্দিরে আসে বলে।

- ও। তোমার কফি ঠান্ডা হয়ে গেলো বকতে বকতে। শেষ করো ওটা!

রিচি হাতের কাপটা কাত করে কফিটা ঢেলে ফেলতে ফেলতে ককথাগুলো বলে যেতে লাগলো::

-ভালো তুমি নেই তা জানি। একজন বন্ধু হিসেবে বলি নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। একটা ১০ সেকেন্ডের স্বপ্ন দেখে মন খারাপ করার জন্য তোমার জন্ম হয় নি। তুমি নিজেও তোমার তুলনা নও।অন্তত তোমার প্রতিআমার বিশ্বাসটা আমারই। প্রাপ্তিই পূর্ণতা নয়, জীবনে পূর্ণতা বলে আরও অসাধারন কিছু আছে। এই যে কফিটা ঢেলে ফেলছি, ভেবে দেখ এটাই পূর্ণতা।

আমার দেরি হচ্ছে। আসি। ভালো থাকতে শিখো।।।।।

কথাগুলো বলে রিচি অরিনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই গাড়ীর ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। ডোরটা লক করেই গাড়ী হাকিয়ে দিলো। কফির কাপটা কিন্তু আঙুলবন্দী হয়েই থাকলো রিচির।

কয়েকমুহূর্ত লাগলো অরিনের ঘোর কাটতে। ঘোর কাটতেই সে রুমের দিকে হাটতে শুরু করলো। সবকিছুই কেমন যেন স্বাভাবিক থেকে অতিস্বাভাবিক হয়ে গেলো। পাঁচ মিনিটের এই কয়েকটা কথা তার জীবনবোধকে বদলে দিচ্ছে। রিচি যেন কাপ থেকে কফি নয়, জীবন থেকে দুঃখবোধগুলোকে ঢেলে ফেলে দিতে শেখালো তাকে। নতুন করে ভাবালো তাকে সবকিছু। আসলে কিছুই তো ঘটে নি। সব ঠিকই তো আছে, যেমনটা থাকার কথা ছিলো ঠিক তেমনটাই আছে। শুধু শুধু সেই সবকিছু অন্যভাবে দেখেছে।

আবার দেখছে অরিন সেই স্বপ্নটা। সেই আবিরের ছড়াছড়ি। তার বাস্তব জীবনের স্বপ্নগুলোকে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আবিরের রঙ। ক্রমশই সবকিছু তার কাছে চেনা হয়ে উঠতেছে, কত পরিচিত। আজ আর তার দম বন্ধ আসছে না। আহ্ কি রঙিন রঙ আবিরের। তাতে ঘ্রাণ আছে গন্ধ নয়। কি স্নিগ্ধ মিষ্টি সে ঘ্রাণ, স্বপ্ন রাঙানো আবিরের ঘ্রাণ।

বিষয়: বিবিধ

৮৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File